Header Ads

ফাঁসির সাতদিন আগে মাকে চিঠি লিখলেন দীনেশচন্দ্র গুপ্ত


ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বীর বিপ্লবী দীনেশচন্দ্র গুপ্তের অবদান অনস্বীকার্য। মাত্র উনিশ বছর বয়সে দেশের জন্য প্রাণ দিতে হলো তাঁকে। তিনি কোনো সাধারণ মৃত্যুগ্রহণ করেননি, তিনি বীরের মৃত্যুবরণ করেছিলেন৷ কিন্তু এ কথাও মাথায় রাখতে হবে যে বীরের কখনো মৃত্যু হয়না। তাই দীনেশরা অমর। অনন্তকালের প্রহরী হয়ে থেকে যাবে তাদের নাম। অল্প বয়স, যে বয়সে অর্ধেক ছেলেমেয়ে দেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে বুঝতে পারেনা। সেখানে এই বয়সেই তিনি বন্দুক হাতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন৷ 


১৯৩০ সালের ৭ ই ডিসেম্বর বিনয়-বাদল-দীনেশ রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেন। সেখানে হত্যা করা হয় ব্রিটিশ ইন্সপেক্টর কর্নেল সিম্পসনকে। তাকে হত্যা করার পর হাজার হাজার ব্রিটিশ পুলিশ তাদের ঘিরে ফেলে৷ তিন বিপ্লবী ব্যক্তি পুলিশের জাল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে বন্দুক হাতে ঝাপিয়ে পড়লেন অলিন্দ যুদ্ধে। তাদের গুলিতে বহু পুলিশ ঝাঁঝরা হতে থাকে। এই তিন বিপ্লবীর বন্দুকের নল হার মানিয়ে দিতে থাকে ব্রিটিশ পুলিশদের। রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণের খবর পেয়ে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট এলেন। সাথে ডেপুটি কমিশনার গার্ডন এলেন সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে। পাদ্রী রেভারেন্ড জনসন ড্রেন-পাইপের মধ্যে পালিয়ে গেলেন৷ জুডিসিয়েল সেক্রেটারি মিস্টার নেলসন, মিস্টার টয়নয় প্রমুখ ব্রিটিশ রাজপুরুষ আহত হন৷ শেষমেশ আক্রমণকে প্রতিহত করতে গোর্খা বাহিনীকে নিয়ে আসা হয়। গোর্খা বাহিনীর সাথে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরমুহূর্তেই রাইফেলে গুলি শেষ হয়ে যায় তিন বিপ্লবীর। প্রত্যেকের বন্দুকে কেবল একটি করে গুলি অবশিষ্ট থাকে। তাঁরা তিনজন শত্রুদের হাতে প্রাণ না দিয়ে একটি ঘরে ঢুকে পড়লেন। ঐ ঘরে বিনয় বসু পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে নিয়ে আত্মঘাতী হন৷ বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত নিজেদের ললাট লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে দেন৷ এই গুলিতে বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত অজ্ঞান হয়ে যান৷ তৎক্ষনাৎ তাদের দুজনকে হাসাপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালে বাদল গুপ্তের জ্ঞান ফেরার পর তিনি ক্ষতস্থানে আঙুল ঠুকিয়ে মারা যান৷ আর দীনেশ গুপ্তের জ্ঞান ফেরার পর আলিপুর জেলে বন্দী করা হয় তাঁকে। 

জেলে বন্দী করার পর আলিপুর আদালতে তাঁর বিচার শুরু হয়। বিচারে তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১৯৩১ সালের ৭ ই জুলাই দীনেশের ফাঁসির দিন ধার্য করা হয়। ঐদিন ভোরবেলা স্নান করে তিনি ফাঁসির পোশাক পরে নিলেন। অতঃপর হাসতে হাসতে সার্জেন্টকে বললেন, 'এবার যাওয়া যেতে পারে।' ধীর পায়ে ফাঁসির উদ্দেশ্যে মঞ্চের দিকে অগ্রসর হলেন। সার্জেন্ট  তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমার কিছু বলার আছে কী বন্দি?' দীনেশ উত্তর দিলেন 'প্লিজ স্টপ৷ আমাদের বলার অধিকার যে কারা কেড়ে নিয়েছে সে কথা তোমরাই ভালো জানো৷ ডু ইউর ডিউটি, আই এম রেডি।' তারপর দীনেশ গুপ্তের গলায় ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দেওয়া হলো। ভয়কে অবজ্ঞা করে তিনি হাসিমুখে মৃত্যুকে মেনে নিলেন। 

দীনেশচন্দ্র গুপ্ত ফাঁসির সাতদিন আগে এক রাত্রিবেলায় মায়ের উদ্দেশ্যে কিছু কথা তিনি  একটি চিঠিতে লিখেছিলেন। যে চিঠি মৃত্যুর ভয়াবহতাকে হার মানিয়ে দিতে পারে। চিঠিতে তিনি লিখলেন- 

"মা,

যদিও ভাবিতেছি কাল ভোরে তুমি আসিবে, তবু তোমাকে না লিখিয়া পারিলাম না৷ তুমি হয়তো ভাবিতেছ, ভগবানের কাছে এত প্রার্থনা করিলাম, তবুও তিনি শুনিলেন না! তিনি নিশ্চয় পাষাণ, কাহারও বুক-ভাঙা আর্তনাদ তাঁহার কানে পৌঁছায় না।  

ভগবান কি, আমি জানি না, তাঁহার স্বরূপ কল্পনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তবু একথাটা বুঝি, তাঁহার সৃষ্টিতে কখনো অবিচার হইতে পারে না। তাঁহার বিচার চলিতেছে। তাঁহার বিচারের উপর অবিশ্বাস করিও না, সন্তুষ্ট চিত্তে সে বিচার মাথা পাতিয়া নিতে চেষ্টা কর। কী দিয়া যে তিনি কী করিতে চান, তাহা আমরা বুঝিব কী করিয়া?  
    
মৃত্যুটাকে আমরা এত বড় করিয়া দেখি বলিয়াই সে আমাদিগকে ভয় দেখাইতে পারে৷ এ যেন ছোট ছেলের মিথ্যা জুজুবুড়ির ভয়৷ যে মরণকে একদিন সকলেরই বরণ করিয়া লইতে হইবে, সে আমাদের হিসাবে দুই দিন আগে আসিল বলিয়াই কী আমাদের এত বিক্ষোভ, এত চাঞ্চল্য? 

যে খবর না দিয়া আসিত, সে খবর দিয়া আসিল বলিয়াই কী আমরা তাহাকে পরম শত্রু মনে করিলাম? ভুল, ভুল-মৃত্যু 'মিত্র' রূপেই আমার কাছে দেখা দিয়াছে। আমার ভালোবাসা ও প্রণাম জানিবে।"

প্রতিবেদন- সুমিত দে 
        
                              

No comments