Header Ads

বিদায় সিনেমাওয়ালার হরিকে, চলে গেলেন অরুণ গুহ ঠাকুরতা


কখনো তিনি সিনেমাওয়ালা, কখনো তিনি মৌলবি মাস্টার।  বাংলা চলচ্চিত্রের স্বনামধন্য অভিনেতা ছিলেন তিনি। যার অভিনয় বারবার মুগ্ধ করে সিনেমা বোদ্ধাদের। যার কাছে চলচ্চিত্রই ছিল জীবন। অথচ প্রচারের আড়ালেই থাকতে হয়েছে সারাজীবন তাঁকে। অনেক মানুষই হয়তো তাঁর নাম জানেন না কিন্তু মুখ দেখলে চিনতে পারেন সকলেই। বিসর্জন, জ্যেষ্ঠপুত্র, সিনেমাওয়ালা, বসু পরিবার, ল্যাপটপ, কেয়ার অফ স্যার, চোলাই, শব্দ, উড়োজাহাজের মতো বিখ্যাত সব ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, কৌশিক গাঙ্গুলী, গৌতম ঘোষ, সুমন ঘোষের মতো কিংবদন্তি পরিচালকদের সাথে তিনি কাজ করেছেন। সহকারী পরিচালক হিসেবে লাল দরজা, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান, কালপুরুষ ও মনের মানুষ ছবিতে তিনি কাজ করেন। তিনি হলেন অভিনেতা অরুণ গুহ ঠাকুরতা। সিনেমাওয়ালা ছবিতে হরির চরিত্রে পরাণ বন্দোপাধ্যায়ের সাথে তিনি অভিনয় করেছিলেন। সিনেমাওয়ালা ছবির বহুদিন পর পরিচালক নাইল ভট্টাচার্য ও দেব গোস্বামীর হাত ধরে পরাণ বন্দোপাধ্যায়ের সাথে একসাথে কাজ করার তিনি সুযোগ পান 'মৌলবি মাস্টার' নামের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে। 'মৌলবি মাস্টার' হলো অরুণ গুহ ঠাকুরতার শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি।  


১৯৬২ সালে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন তিনি। প্রথম জীবনে থিয়েটারের সাথে যুক্ত  ছিলেন তিনি। সাঁকো নামের একটি নাটকে তাঁর সাথে আলাপ হয় খ্যাতনামা পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সাথে। বিসর্জন নামে একটি নাটকে তাঁরা একসাথে অভিনয় করেন। ঋত্বিক ঘটক রঘুপতি এবং অরুণ গুহ নক্ষত্র রায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন বিসর্জন নাটকে। ঋত্বিক ঘটকের হাত ধরেই তিনি সিনেমাতে নাম লেখান। ঋত্বিক ঘটকের সহকারী চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ শুরু করেন। একটা সময় ছিল যখন টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে কান পাতলে সহকারী পরিচালক হিসেবে  অরুণবাবুর নাম শোনা যেত। নতুন হোক বা একটু পুরানো পরিচালক সবার কাছেই সহকারী পরিচালক হিসেবে শেষ ভরসা তিনিই ছিলেন। বলা চলে টলিউডের সর্বশ্রেষ্ঠ সহকারী পরিচালক ছিলেন তিনি। 

তাঁর গলার আওয়াজে অধিক মিষ্টতা লক্ষ্য করা যেত। রাঢ়ি উপভাষা হোক কিংবা বঙ্গালি উপভাষা যে-কোনো ভাষার ধরনে তিনি দক্ষ ছিলেন৷ তিনি কথা বললে যেন মনে হতো কথাগুলো কতোই না মায়াতে ভরা৷ মোটাসোটা গোল মুখখানা তাঁর সুন্দর চেহারা সকলেরই বেশ পছন্দের ছিল। তিনি মানুষ হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক। সততা ও নিষ্ঠার সাথে আবহমান কাল ধরে তিনি নিজের শিল্পসত্ত্বা প্রদর্শন করেছেন৷ আমরা দেখেছি টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী বিভিন্ন ভাবে ইন্ডাস্ট্রিকে ছোটো করার চেষ্টা করেন, এমন চেষ্টাতে তিনি কখনো পা মাড়ান নি৷ ইন্ডাস্ট্রিকে তিনি সর্বদা সৎ চোখে দেখেছেন৷ তাঁর অভিনীত সিনেমার সংখ্যা হয়তো কিছুটা কম কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি তাঁর জন্য গর্বিত। 

অরুণ গুহ ঠাকুরতা কেবল বাংলা ছবিই নয়, তিনি অসমিয়া ও মণিপুরী ছবিতেও অভিনয় করেছেন। তিনি কর্মসূত্রে অসমে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। সেই সুবাদেই অসমিয়া ভাষাও তিনি সুন্দর ভাবে রপ্ত করে নিয়েছিলেন। প্রাণবন্ত স্বভাবের এই মানুষটি টলিউডের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল৷ ছোটো ছোটো চরিত্র তিনি যত্ন সহকারে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতেন৷ কখনো তাঁর নামে কোনো খারাপ অভিযোগও কাউকে করতে শোনা যায়নি৷ 

গত মঙ্গলবার দুপুর ১ টা বেজে ৪৫ মিনিটে জীবনাবসান ঘটলো অরুণবাবুর। করোনার সংক্রমণে জীবন ঝরে গেল তাঁর। টলিউডে করোনার প্রথম শিকার তিনি৷ তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রিতে থাবা বসালো করোনা। বাঙুর হাসপাতালে কয়েকদিন আগে তিনি ভর্তি হন। সেখানে তাঁর করোনা পরীক্ষা করা হয়৷ যার রিপোর্ট আসে পজেটিভ। অবশেষে গত মঙ্গলবার জীবনের সমস্ত হিসেব ও চলচ্চিত্রের পাঠ চুকিয়ে এ বিশ্বকে বিদায় জানালেন তিনি৷ চলে গেলেন সিনেমাওয়ালার হরি৷ তাঁর মৃত্যুতে শোকাগত টলিউডমহল। চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের আকস্মিক মৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক। যে ব্যক্তিটি কালও শ্যুটিং সেটে আসর জমিয়েছেন, ভাবতে অবাক লাগে কোনো এক মারণরোগ একনিমেষে তাঁকে কেড়ে নিলো৷ 

প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments