Header Ads

বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড ইতিবৃত্ত- তৃতীয় পর্ব


                                                                                    
প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক দ্রব্য ও বিভিন্ন রকমের ওষুধ বিজ্ঞানসম্মতভাবে তৈরি করে ব্যবসা করার কাজ এই বঙ্গদেশে সর্বপ্রথম 'বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস'-ই শুরু করে। আচার্যদেব তাঁর প্রবন্ধটিতে বঙ্গদেশকে 'বাংলাদেশ' বলে অভিহিত করেছেন। যাইহোক, প্রথমে এই কোম্পানি দেশীয় গাছ-গাছরার থেকে ওষুধ তৈরি করার কাজে মনোনিবেশ করেছিল। পরে যদিও এই কোম্পানির সফলতার সাথে সাথে তার কাজের পরিমাণও হাজার গুণ বেড়ে যায়।


বেঙ্গল কেমিক্যালের শুরুটা হয়েছিল অতি সামান্যভাবেই। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় নিজেও কোনোদিন ভাবতে পারেননি যে 'অণুসমান বীজ' থেকে 'এত বড় গাছে' গজিয়ে উঠবে। সেই 'অণুসমান বীজ'-টি পোঁতা হয়েছিল ৯১,আপার সার্কুলার রোডের ভবনে। এখানে উল্লেখ্য এই যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই আপার সার্কুলার রোডের নাম হয় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড বা এ পি সি রোড। যাইহোক, স্থাপন করার পর ক্রমশ বেঙ্গল কেমিক্যালের কাজ প্রসারিত হতে থাকে ও তাদের তৈরি করা জিনিস বিক্রি হতে থাকে। সেই সময় বিলেতি অনুকরণের জন্যে হোক বা যেকোনো কারণের জন্যই হোক না কেন এদেশের লোকেরাই এখানকার লোকেদের তৈরি ওষুধে বিশ্বাস রাখত না। বলতে দ্বিধা নেই, বেঙ্গল কেমিক্যালই দেশীয় লোকেদের সেই ভুল দুর করেছিল। আচার্যদেব জানিয়েছেন যে, বেঙ্গল কেমিক্যালের কল্পনা তাঁর মাথাতেই প্রথম এসেছিল ঠিকই কিন্তু সেই কল্পনা, কল্পনাতেই থেকে যেত যদি না এর সাথে তিনি স্বদেশভক্ত এবং স্বার্থত্যাগী কয়েকজন বন্ধুর প্রাণপণ সহায়তা না পেতেন। কেননা, এইসব কাজে সমমনষ্ক, একান্ত উদ্যোগী মানুষের সহায়তা খুবই দরকার।

লেখার পঁয়ত্রিশ বছর আগে আচার্যদেব ৯১, আপার সার্কুলার রোডের বাড়িটির একটি ঘরে বসবাস করতেন। তখন বাড়িটির চারপাশে খোলা জমি ছিল। সেই খোলা জমিতে পড়ে থাকত খোলা, ভাঁড়, পিপা, কলসি ইত্যাদি। মজার কথা, তখন এইসব পাত্রেই  তৈরি হত তেজাব্ (অ্যাসিড), জম্বীরাম্ল (নাইট্রিক অ্যাসিড, সাইট্রিক অ্যাসিড), হীরাকষ ইত্যাদি রাসায়নিক দ্রব্য। সেই সময় কারখানা বাড়ির ছাদে কসাই-এর দোকান থেকে কাঁচা হাড় কিনে এনে রোদে শুকোতে দেওয়া হত। এইসব হাড় পুড়িয়ে, হাড়ের সেই ভস্ম বা ছাই থেকে ফসফরাসঘটিত ওষুধ তৈরি হত। তা, এই হাড়-এর জন্যই পাড়ার লোকেরা আলোচ্য রাসায়নিক কোম্পানির ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে যায়। যাইহোক, এভাবে নানান উপায় বাতলে সামান্য একটি কোম্পানির গোড়াপত্তন হয়েছিল। শুরুর দিকে, আচার্যদেবের মূলধন অর্থাৎ অর্থ তেমন ছিল না। আচার্যদেব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তাঁর সহকর্মীদের প্রতি এবং লিখেছেন যে ভগবানের কৃপায় যে কজন সহকর্মীদের পাওয়া গিয়েছিল তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের নিজেদের সব শক্তি ও স্বার্থ বেঙ্গল কেমিক্যালকে দিয়েছিলেন।  

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রথম সহযোগী হিসেবে লাভ করেছিলেন তাঁর এক বাল্যবন্ধুকে, সেই বাল্যবন্ধুর নাম ডাঃ অমূল্যচরণ বসু(১৮৬২ - ১৮৯৮)। এখানে উল্লেখ্য যে, এই ডাঃ অমূল্যচরণ বসু ছিলেন একজন বিখ্যাত চিকিৎসক যিনি কলকাতা মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। স্বল্পায়ু এই চিকিৎসক ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিদ্যার একজন কৃতী ছাত্র। ডাঃ অমূল্যচরণ ছিলেন দেশীয় ওষুধ বিলাতি উপায়ে তৈরি করবার প্রথম পথপ্রদর্শক। তা এই ডাক্তারবাবুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কোম্পানির তৈরি দেষজ ওষুধপত্র ডাক্তারি মহলে খ্যাতি লাভ করেছিল। ডাঃ অমূল্যচরণের যোগদানের কিছুদিন পরে তাঁর ভগ্নীপতি সতীশচন্দ্র সিংহ এই কোম্পানিতে যোগ দেন। তিনি রসায়নবিদ্যায় এম.এ. পাস করেই যোগ দিয়েছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালে। কিন্তু এর মধ্যে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। তখন সতীশচন্দ্র অল্প কিছুদিন হল কারখানায় যোগ দিয়েছেন। একদিন কারখানার কাজ করতে করতেই ভুল করে প্রুসিক অ্যাসিড (যার অপর নাম  হাইড্রোজেন সায়ানাইড এবং এটি বর্ণহীন ও অত্যন্ত বিষাক্ত রাসায়নিক যৌগ বলে পরিচিত) খেয়ে বসলেন! ব্যস, এতেই তাঁর মৃত্যু হল। এই বেদনা নিয়েও বেঙ্গল কেমিক্যাল তার দেশ সেবার কাজে থেমে থাকেনি।

দুঃখের বিষয় এই যে, ডাঃ অমূল্যচরণও বেঙ্গল কেমিক্যালের গোড়াপত্তনের পর কিছুকাল কাজ করতে পেরেছিলেন এবং কোম্পানিটি লিমিটেড হওয়ার আগেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়নবিদ্যার অধ্যাপক চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ি, ডাক্তার কার্তিকচন্দ্র বসু সহ অন্যান্য বহু সহকর্মীরা প্রচুর পরিশ্রম করে যাকে বলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বেঙ্গল কেমিক্যাল কোম্পানির ভিত শক্ত করেছিলেন। এই চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ি ছিলেন একজন নামকরা রসায়নবিদ। আচার্য রায়ের প্রেসিডেন্সি কলেজের খুব কাছের সহকর্মী ছিলেন তিনি। শুধু বেঙ্গল কেমিক্যালে নয়, আচার্য রায় ও আলেকজান্ডার পেডলার সাহেবের সাথে যোগ দিয়ে চন্দ্রভূষণ প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়নের ল্যাব গঠন করেছিলেন। কার্তিকচন্দ্র  বসুও ছিলেন তৎকালীন সময়ের একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক। এঁর নামেই কলকাতার কেন্দ্রে অবস্থিত ডাঃ কার্তিক বোস স্ট্রিট নামকরণ করা হয়। ইনি ছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল কোম্পানির পরিচালন অধিকর্তা এবং ইস্কনের প্রতিষ্ঠাতা অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ-এর পারিবারিক চিকিৎসক এবং প্রভুপাদের পিতার অন্তরঙ্গ বন্ধু। 

No comments