Header Ads

বাঙালির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাওয়ার নেপথ্যের কিছু কথা


একটু চোখ মেললেই দেখা যায় অনেক বাঙালি মনে করেন হিন্দি ও ইংরেজি বললেই আধুনিক হওয়া যায়। হিন্দি তো আমাদের রাষ্ট্রভাষা। আমি বাঙালি হলেও বাংলা বলতে অতোটা স্বাচ্ছন্দ বোধ করিনা। কারণ কী হবে বাংলা শিখে? এমনই কিছু নেগেটিভ চিন্তাভাবনা ঘুরতে থাকে তাদের মনে। ফলে এই সব মানুষদের ভাবনাতে বাংলা ভাষা খানিকটা কোণ ঠাসা হয়ে পড়েছে। 


আমাদের বাঙালি সমাজে বেশ কিছু অভিভাবক রয়েছেন যারা নিজের ছেলেকে ইংলিশ বা সিবিএসসিতে ভর্তি করিয়েছে। ছেলে-মেয়ে ইংলিশ আর হিন্দিতে গড়গড় করে কথা বলছে। মোবাইলে সারাক্ষণ হিন্দি আর ইংলিশ গান শুনছে। সারাক্ষণ হিন্দি ও ইংলিশ সিনেমা দেখছে৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছেড়ে চেতন ভগৎ পড়ছে। সত্যজিৎ রায়কে ভুলে গিয়ে নজর শুধু জেমস বন্ডের দিকে৷ এসব দেখে বাড়ির অভিভাবকেরা মনে করেন ছেলেটা সত্যিই একালের সাথে মানাতে পারবে। তারা গর্ব করে বলে থাকেন আমার ছেলে প্রচন্ড স্মার্ট। হিন্দি আর ইংলিশে বেশ দক্ষ। আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসেনা। ভবানীপ্রসাদ মজুমদার যিনি মধ্যবিত্ত বাঙালিদের দেখে লজ্জিত হয়ে একটি কবিতা লিখে ফেললেন। যার নাম দিলেন 'আমার বাংলাটা ঠিক আসেনা।'  

অভিভাবকদের বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান না দেখানো। নিজের ছেলে-মেয়েদের লাখ লাখ টাকা খরচ করে তাদের হাতে আইপড, ট্যাব, দামী মোবাইল, ল্যাপটপ কিংবা ম্যাকবুক তুলে দিচ্ছে। ছেলেকে ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়াচ্ছে। ছেলে-মেয়েকে দামী দামী পোশাক, ঘড়ি, জুতো কিনে দেওয়া হচ্ছে। ছেলে-মেয়ে হাজার হাজার টাকা খরচ করে সেলুন বা পার্লারে গিয়ে রূপচর্চা করছে। নিজেদের সাহেব করে তুলতে তারা বাংলা ভুলে গিয়ে পশ্চিমী সভ্যতাকে অনুকরণ করছে। আর ভারতে টিকে থাকার জন্য উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করছে। আমাদের অভিভাবকেরা একবারও বাংলা নিয়ে নিজের ছেলে-মেয়েদের বাংলা সম্পর্কে সচেতন করছে না। আমরা বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভুলে গেছি দোলের কথা৷ বাঙালিরা কখনো হোলি খেলেনা, বাঙালিরা আবির হাতে দোল খেলে। হোলি ব্যাপারটা উত্তর ভারত থেকে আমদানি করা। আজকে আমরা দোল ছেড়ে রাস্তায় নেমে হোলি খেলতে যাই৷ দুর্গাপুজোকে আমরা ইদানীং দুশেরা বলছি। দীপাবলিকে দিওয়ালি বলছি। হ্যাপি ছট লিখে ছট পুজো বানাচ্ছি। স্বাধীনতাকে আমরা আজকে আজাদী বলছি। কারণ কী ভুলে গিয়ে কেন কী বলছি। উত্তম কুমার ছেড়ে খান-দেওয়াল গ্রহণ করছি। 

দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো যেখানে নিজেদের ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নতি করছে নিজেদের। জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেনের মতো দেশ যেখানে মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে সেখানে আমরা বাঙালিরা অন্য ভাষা গ্রহণ করার মতো নির্বোধ খেলাতে মত্ত। ফ্রান্স আয়তনে অনেক ছোটো একটা দেশ। ফ্রান্সের প্রধান ভাষা ফ্রেঞ্চ। সারা পৃথিবীতে প্রায় ছয় থেকে সাত কোটি মানুষ ফ্রেঞ্চ ভাষাতে কথা বলেন। আর সারা পৃথিবীতে ত্রিশ কোটি মানুষ বাংলা ভাষাতে কথা বলেন। অথচ ফ্রেঞ্চ ভাষা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে বাংলা ভাষার থেকে অনেকাংশে এগিয়ে রয়েছে। এর একটাই কারণ ফরাসীরা নিজের মাতৃভাষার প্রতি সচেতন। আর বাঙালিরা নিজের মাতৃভাষার প্রতি অসচেতন। 

বাংলা সাহিত্যের যে ভাণ্ডার আছে তা এককথায় গর্ব করার মতো। আমাদের বাংলা ভাষাতে যখন সব আছে তাহলে আমরা অন্য ভাষাকে নিজের ভাষার থেকে বড়ো করে দেখবো কেন? আসল প্রশ্ন এখানেই। ফ্রেঞ্চ ভাষাতে টিনটিন লেখা হয়েছে। যা আজকে গোটা পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত। আমাদের বাংলা ভাষাতে প্রফেসর শঙ্কু লেখা হয়েছে। কিন্তু প্রফেসর শঙ্কু গোটা পৃথিবী জুড়ে মার্কেট করতে পারেনি। কারণ বাঙালিরা বাংলা ভাষার প্রতি সচেতন নয়। 

আজকে একজন বাঙালির কাছে হিন্দি বা সাউথের যে-কোনো ছবি দিন সেটা সে মন দিয়ে দেখে ফেলবে। হয়তো সেই ফিল্মটিতে হাজারো মিসটেক থাকার পরও সে গর্ব করছে ঐ ফিল্মটি নিয়ে। আমাদের বাংলাতে আপনি হয়তো কোটি কোটি টাকা খরচ করে সহস্র বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সেই ছবি দেশ-বিদেশে প্রচুর পুরস্কার জিতেছে। বিদেশের মানুষও হয়তো সেই ছবিটি প্রশংসা করেছেন। আর এই জায়গায় বেশ কিছু বাঙালি দর্শক ওঁৎ পেতে বসে থাকেন ভুল ধরবার জন্য। চলচ্চিত্রটি যে কষ্ট করে বানানো হয়েছে। চলচ্চিত্রটি যে পুরস্কার জিতেছে সেদিকে কোনো হেলদোল নেই৷ মানে পুরো ব্যাপারটা হলো হিন্দিতে যাই বানাক না কেন ওদের ভুল ধরবো না, ওরা অশালীন ছবি বানালেও সেটা গ্রহণ করবো। আর বাংলা ছবির ভুল ধরবো। ভালো বাংলা ছবি বানালেও সেটা গ্রহণ করবো না। কারণ হিন্দি হলো ভারতের রাষ্ট্রভাষা। আমি ভারতীয়। হিন্দি হায় হাম। এখানেই সবচেয়ে বড়ো ভুলটা করে বসে বাঙালিরা। 

প্রতিটি বাঙালিকে জানতে হবে যে ভারতের কোনো রাষ্ট্রভাষা নেই। ভারতের প্রধান বাইশটি ভাষায় হলো ভারতের রাষ্ট্রভাষা। ভারতের সংবিধানেও লেখা আছে যে  হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয়৷ আপনি আপনার মাতৃভাষা নিয়ে সহজেই গর্ব করতে পারবেন। সংবিধানের ৩৪৫ নম্বর ধারাতে কাজের ক্ষেত্রে হিন্দি বা ইংরেজি ব্যবহার করার উল্লেখ থাকলেও ভারতের কোনো রাষ্ট্রভাষা নেই৷ ভারতের প্রতিটি কেন্দ্র  সরকার হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মিথ্যে প্রচার চালিয়ে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদকে অহিন্দি ভাষীদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। অথচ সংবিধানের ৩৫ নম্বর ধারাতে মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। মৌলিক অধিকার মানে আপনার নিজের ভাষা নিয়ে গোটা ভারতবর্ষে কাজ করবার নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে। 

ভারতের সংবিধান না জানা, বাংলা ভাষা বলতে কিছু বাঙালির লজ্জাবোধ, হিন্দি ভাষার প্রতি আবেগ, উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রেরণা, ইংলিশ মিডিয়াম কালচার, সিবিএসসি কালচার, হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ তিল তিল করে বাংলা ভাষার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে ফেলেছে। আজকে কেন্দ্র সরকারের কোনো পরীক্ষা বাংলাতে হয়না৷ ব্যাঙ্কের ফর্মে বাংলা রাখা হয়না। পাসপোর্টে পর্যন্ত বাংলা রাখা হয়না। সংসদে আপনাকে বাংলা বলতে গেলে দশবার ভাবতে হয়। আপনি নিজের এলাকাতে উৎসব-পার্বণে বাংলা গান চালাতে ভয় পান। বাংলা চলচ্চিত্র দেখে আপনারা নাক সিটকান। বাংলা বই পড়তে লজ্জিত বোধ করেন। আপনাদের বাংলা ও বাঙালি সম্পর্কে নূন্যতম জ্ঞান নেই। আপনারা মনে করেন বাঙালিরা দুর্বল ও অলস।

বাংলা ভাষা ধ্বংস হলে আজকে দায়ী থাকবে বাঙালিরাই। নিজের ভাষার অধিকার নিজেকেই বুঝতে হবে। আপনার ভাষা ধ্বংস হলে আপনি অন্য জাতির ওপর দোষ চাপাতে পারেন না। আপনাকে নিজের দোষটা মেনে নিতে হবে। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যেমন আপনাকে লড়তে হবে তেমনই নিজের ভাষার প্রতিও সচেতন  হতে হবে।

No comments