Header Ads

তিনি হলেন বাংলার আরেক সরস্বতী। যিনি জন্ম দিয়েছেন বাংলার প্রথম মেয়ে ডিটেকটিভ 'কৃষ্ণা'র


বাংলার মেয়ে ডিটেকটিভ ব্যাপারটা বেশ একটু অচেনা। ব্যোমকেশ, ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু, ঘনাদা, শবর দাশগুপ্ত, কিরিটি প্রভৃতি গোয়েন্দা চরিত্রগুলি বাঙালির বেশ প্রিয়। এনারা সকলে হলেন পুরুষ গোয়েন্দা কিন্তু বাংলার মহিলা গোয়েন্দার ব্যাপারে কী জানেন? অনেকের জানা থাকলে থাকতেও পারে৷ তবে বেশিরভাগ বাঙালির কাছে মহিলা ডিটেকটিভের বিষয়টা আলাদা। সাহিত্যিক সূচিত্রা ভট্টাচার্যের 'মিতিন মাসি' আমরা অনেকে পড়েছি। কিন্তু মেয়ে ডিটেকটিভকে প্রথম নিয়ে আসেন অন্য একজন সাহিত্যিক। প্রভাবতী দেবী সরস্বতী হলো বাংলার প্রথম লেখিকা যিনি বাংলাতে প্রথম জন্ম দেন মেয়ে ডিটেকটিভের। 


প্রভাবতী দেবী সরস্বতী যে নামটির সাথে বাঙালিরা সচরাচর পরিচিত নয়। তিনি ছিলেন একজন মহান সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী ও গীতিকার। ১৯০৫ সালের ৫ ই মার্চ অবিভক্ত ২৪ পরগণার গোবরডাঙ্গার খাঁটুরা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রখ্যাত আইনজীবী গোপাল চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি সাহিত্য অনুরাগী হয়ে ওঠেন। তিনি বাবার উৎসাহে কীটস, শেলি ও বায়রনের মতো কবিতা অল্প বয়সেই পড়ে ফেলেন। তিনি কখনো স্কুলের গন্ডী টপকাতে পারেননি। মাত্র নয় বছর বয়সে গৈপুর গ্রামের বিভূতিভূষণ চৌধুরীর সাথে তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়। এতো কম বয়সে সংসার সম্পর্কে তাঁর বিশেষ কোনো ধারণা ছিলনা। সংসারে মন না থাকার জন্য তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছিল। 

স্কুলের গণ্ডি টপকাতে না পারা, বিচ্ছেদের স্বীকার অসহায় মেয়েটা মাত্র এগারো বছর বয়সে কলমে ধরলেন। লিখে ফেললেন প্রথম কবিতা 'গুরুবন্দনা'। যা প্রকাশ পেল তত্ত্বমঞ্জরী পত্রিকায়। এরপর লিখলেন ছোটো গল্প 'টমি'। প্রকাশ পেল অর্চনা পত্রিকায়। তাঁর লেখা কলকাতার বুকে বেশ সমাদৃত হতে লাগলো৷ তিনি মন দিলেন উপন্যাস লেখার কাজে। তাঁর লেখা উপন্যাস যেমন 'বিপ্লবীর স্বপ্ন' স্বদেশপ্রেমের সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর লেখা ধারাবাহিক উপন্যাস 'বিজিতা' জলধর সেন সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। যে উপন্যাসটি পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়। বাংলা, হিন্দি ও মালয়ালমে এই উপন্যাসটি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। সর্বপ্রথম বাংলাতে 'ভাঙাগড়া' নামে ছবি মুক্তি পায়। এরপর হিন্দিতে 'ভাবী' নামে মুক্তি পায়। সবশেষে মালয়ালম ভাষাতে 'কুলদেবম্' নামে ছবি মুক্তি পায়। 

তিনি প্রায় তিনশোরও বেশি গ্রন্থ রচনা করে ফেলেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি একজন উজ্জ্বল তারকা হয়ে ওঠেন। তাঁর লেখনী শহর জুড়ে সাড়া ফেলে দেয়। তিনি নিজের হাতে জন্ম দেন বাংলার প্রথম মেয়ে ডিটেকটিভ 'কৃষ্ণা'। এই চরিত্রটি নিয়ে অসংখ্য উপন্যাস লিখেন তিনি ধারাবাহিক ভাবে। 'কৃষ্ণা' গোয়েন্দা চরিত্রের উপন্যাস 'ইন্টারন্যাশনাল সার্কাস' বাচ্চাদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল। এই গোয়েন্দা চরিত্রের আরেকটি উপন্যাস 'পথের শেষে' যা 'বাংলার মেয়ে' নামে সাফল্যের সাথে মঞ্চস্থ হয়েছিল। 

তাঁর লেখনীর মধ্যে নারীদের আর্থসামাজিক অবস্থা ভেসে উঠতো। একজন নারীর অসীম ক্ষমতা, দক্ষতা ও সাহস নিয়ে তিনি সৃষ্টি করেন মেয়ে গোয়েন্দা 'কৃষ্ণা'র। একজন মেয়ে নিজের উপস্থিত বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে সেই সবকিছু তুলে ধরা হয় 'কৃষ্ণা' সিরিজে। মেয়েদের সম্পর্কে প্রভাবতী দেবী বলেছেন "মেয়েদের শাসন আমাদের দেশে বড়ই কড়া। তাহাদের অতি শিশুকাল হইতেই কঠোর শাসনের তলে থাকিতে হয়। যে সময়টা বিকাশের, সে সময়টা তাহাকে বন্ধ রাখা হয়। অন্যদেশে যে সময়টা বালিকাকাল বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে, আমাদের দেশের মেয়েরা সেই সময়ে গৃহের বধূ, অনেক সময়ে সন্তানের মা।"   

প্রভাবতী দেবীকে সাহিত্যে অবদানের জন্য নবদ্বীপের পন্ডিত সমাজ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে 'সরস্বতী' উপাধিতে ভূষিত করে। নারী সমাজ, স্বদেশ ও সামাজিক বিষয়ই তাঁর লেখাতে প্রকাশ পেত। গোয়েন্দা 'কৃষ্ণা' সেকেলে দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। অথচ আমাদের সংকট যে এতো বড়ো একজন সাহিত্যিকের কথা আমরা জানিনা। আমাদের প্রজন্মের কাছে অপরিচিত মেয়ে ডিটেকটিভ 'কৃষ্ণা'। আজকে কলকাতার মতো শহরে প্রভাবতী দেবীর বই চাইলে সহজে পাওয়া যায়না। তাঁর বই খুব কম কিনতে পাওয়া যায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রভাবতী দেবীর লেখার সাথে পরিচিত করতে এই বছর কলকাতা বইমেলাতে দেবসাহিত্য কুটির থেকে নবসংস্করণ হিসেবে চাহিদামতো প্রভাবতী দেবীর বই প্রকাশিত হয়। 

প্রভাবতী দেবী হলেন বাংলার আরেক সরস্বতী যিনি হাতের ছোঁয়াতে অনায়াসে লিখে গেছেন তিনশোরও বেশি গ্রন্থ। যিনি গোয়েন্দা 'কৃষ্ণা'কে সৃষ্টি করেছেন। নারীশক্তিকে জাগানোর চেষ্টা করেছেন লেখার মাধ্যমে। নিজের জীবন তিনি উৎসর্গ করেছিলেন সাহিত্যচর্চার কাজে। প্রভাবতী দেবীর মতো এমন প্রতিভাবান মহিলা সাহিত্যিক বাংলাতে আজও বিরল। কোনো শিক্ষাগত ডিগ্রি ছাড়াই সাহিত্যের বাগদেবী হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাঁর নাম।

No comments