Header Ads

বাঙালি এক চা শ্রমিকের পদ্মশ্রী পাওয়ার কাহিনী


জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম ধালাবাড়ি। চারিদিকে চা বাগান, পাহাড়ি রাস্তা। শহুরে আধুনিক জীবন ছুঁতে পারেনি এই অঞ্চলকে। অধিকাংশ মানুষই পেশায় চা শ্রমিক। দারিদ্র তাদের নিত্যসঙ্গী। সালটা ১৯৯৫। আজ থেকে ২৪ বছর আগের দিনটার কথা আজও পরিষ্কার মনে আছে ওই গ্রামেরই বাসিন্দা পেশায় সুবর্ণপুর চা বাগানের চা শ্রমিক করিমুল হকের। রাত তখন এগারোটা। হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হন করিমুল হকের মা জফুরান্নেসা। ধালাবাড়ি গ্রাম থেকে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতাল প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পথ ৷ পাহাড়ি জঙ্গলঘেরা সেই পথে অত রাতে যানবাহন কোথায়! তাও দাদাকে সঙ্গে নিয়ে, সেই রাতেই করিমুল ছুটে বেড়িয়েছেন, গ্রামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, যদি কোনও যানবাহন মেলে ৷ কিন্তু মেলেনি ৷ চোখের সামনে ছটফট করতে করতেই ভোররাতে মারা যান মা। বিনা চিকিৎসায় মা কে হারানো করিমুল হক শপথ নিয়েছিলেন, তিনি নিজের জীবন দিয়ে তার গ্রাম ও আশেপাশের অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দেবেন, গ্রামের আর কাউকে কখনও হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে বাড়িতে পড়ে থেকে মরতে দেবেন না।



সেই শুরু। প্রথম দিকে সাইকেলে করেই রোগী নিয়ে ছুটতেন। রোদঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে রাতবিরেতে ছুটে গেছেন। চা -বাগানে কাজের সূত্রে, ম্যানেজারের কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলেন বাইক চালানো। তারপর কখনও কারও থেকে বাইক চেয়ে, কখনও ভ্যান রিকশা, বাসে চাপিয়েই তিনি গ্রামের নানা প্রান্ত থেকে আসা রোগীদের নিজ দায়িত্বে নিয়ে গিয়েছেন জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতাল। ৪০০০ টাকা মাসিক আয়ে একটা বাইক কেনা অসম্ভব ছিলো। ধীরে ধীরে ধারদেনা করে ২০০৭ সালে নিজেই একটি মোটর সাইকেল কিনে নেন তিনি। মোটর সাইকেলের সামনে লিখে দেন বিনামূল্যের অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবার দেওয়ার কথা। শুরুর দিকে তাকে অনেক তাচ্ছিল্য সহ্য করতে হয়েছে। লোকে তার কাজ দেখে উপহাস করতো কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না করিমুল| তিনি অসুস্থ মানুষকে নিজের বাইকের পিছনে কাপড় দিয়ে বেঁধে হাসপাতালে পোঁছে দেন। সেই থেকে আজ অবধি এলাকার কাছে -দূরের প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি রোগীকে গ্রাম থেকে হাসপাতাল পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। বাঁচিয়ে তুলেছেন হাজারো মুমূর্ষ রোগীকে। ধালাবাড়ির আশপাশের ২০টা গ্রামের বাসিন্দাদের একমাত্র ভরসা কারিমুলের বাইক অ্যাম্বুল্যান্স। কিছুদিন হল ৬ ফুট বাই ২ ফুট একটা কাঠের বাক্স বানিয়ে , জুড়ে দিয়েছেন সেই বাইকের সঙ্গে। বাইকেই মজুত অক্সিজেন, স্যালাইন, ফার্স্ট এড বক্স। প্রায় কুড়ি বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় তিলে তিলে স্বপ্নকে সত্যি করেছেন। ৫৩ বছর মানুষটিকে সকলে একডাকে চেনে অ্যাম্বুলেন্স দাদানামে। করিমুলের কথায়, ‘মা আমার অনুপ্রেরণা। তা ছাড়া আমি যে চা বাগানে কাজ করি তার মালিক সুকুমার দাস আমাকে কাজের ক্ষেত্রে অনেক ছাড় দেন। তাছাড়া পুলিশ ও প্রশাসনের সাহায্য পাই। স্কুলের দিদিমনিরাও অনেক সাহায্য করেন।' হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে কখনও হয়তো হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসেছেন তিনি, এমন সময় হয়তো ফের কোনো রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডাক পড়ল করিমুলবাবুর। খাওয়া ওভাবেই রেখে তিনি ওই রোগীকে নিয়ে ফের রওনা হয়ে যান হাসপাতালের দিকে। মাকে হারিয়েছেন। তাই আর কাউকে হারাতে চান না করিমুল। সমাজসেবা প্রসঙ্গে করিমুল হক বলেন, “আমাকে সংবর্ধনা দেওয়ার ক্ষেত্রে কেউ যেন ফুলের মালা না দেন। সেই টাকায় পোশাক কিনে দিলে আমি খুশি হই। কারণ ওই পোশাক গরিবদের বিতরণ করতে পারি। " শুধু জলপাইগুড়িই নয় ডুয়ার্সসহ গোটা বাংলার মানুষ আজ গর্ববোধ করছেন করিমুল হককে নিয়ে। ২০১৭ সালে করিমুল হক দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা "পদ্মশ্রী" সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।

তার দুই ছেলেও তাকে অনুসরণ করেছেন। তারাও অ্যাম্বুলেন্স চালান। কোনও মহিলা রোগীর দরকারে তার স্ত্রী সেবা করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে তিনি নিজেই রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এজন্য প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেছেন তিনি। তার কথায়, ‘প্রথম দিকে আমি রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ দিতাম। আমি কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পারি। আমার এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। নইলে এর হিতে বিপরীত হতে পারে। এরপর আমি বিভিন্ন কোর্স সম্পন্ন করেছি। স্থানীয় চিকিৎসকদের কাছেও প্রশিক্ষণ নিয়েছি।শিলিগুড়ির এক সার্জেনের থেকে সেলাই করাও শিখে নিয়েছেন ৷ রোগীদের স্টিচ-ওয়াশ সব তিনি নিজেই করেন। এলাকায় একাধিক সমাজসেবামূলক কাজে তাঁর ডাক পড়ে। কোথাও রক্তদান শিবির হলে ডাকা হয় করিমুল হককে। আবার কোথাও বস্ত্র বিতরণ হলে ডাক পান তিনি। এছাড়াও চা বাগানের কর্মীদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে থাকেন তিনি। এরই মধ্যে করিমুল হকের কাজে খুশি হয়ে বাজাজ অটোমোবাইল তাকে একটি বিশেষভাবে নকশা করা বাজার ভি১৫ মডেলের মোটরসাইকেল উপহার দিয়েছে। যেটার একপাশে ছাউনিসহ রোগীর শোয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। আছে অক্সিজেন সিলিন্ডারও। দেশের প্রত্যন্ত, দুর্গম এলাকায় করিমুলের এই অ্যাম্বুলেন্স বাইক ব্যবহার করা যায় কি না তা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেছে মন্ত্রক। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় কর্তব্যরত সেনাকর্মীদের স্বাস্থ্য পরিষেবায় এই বাইক ব্যবহার করতে চাইছে তারা। ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (ডিআরডিও) ইতিমধ্যে এক প্রতিনিধিদলকে দিল্লি থেকে জলপাইগুড়ি পাঠিয়েছে।

কিন্তু এখানেই থেমে থাকতে চাননি অ্যাম্বুল্যান্স দাদা করিমুল হক। তাঁর নিজের পৈত্রিক জমিতে স্বপ্নের প্রকল্প দাতব্য মানব সেবাসদন’-এর জন্য অর্থের জোগাড় করছেন ছুটে ছুটে। সরকারি সাহায্য পেলে একবারে সমস্তটার সুরাহা হয়ে যেত, কিন্তু পাননি। তবে তার জন্য বসে থাকতে নারাজ তিনি। তিনি বলেন, “আমি মানুষের পাশে দাঁড়াই। মানুষ আমার পাশে দাঁড়াবে। এটা আমার বিশ্বাস। তাছাড়া এসব মানুষের জন্যই। তাই আশা করছি সকলে আমার পাশে থাকবে। একটু সময় লাগবে, কিন্তু নিশ্চিত তা দ্রুত রূপায়ন হবে।তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন বহু মানুষ, বিভিন্ন ক্লাব ও সংস্থা। প্রতিটি সাহায্যই যে তাঁর কাছে এক একটা ইটের সমান, তা নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিলেন তিনি। তাঁর নিজস্ব জমি দান করেছেন তিনি। তাঁর স্বপ্নের দাতব্য সেবাসদনের জন্য আপাতত তৈরি হয়েছে একটি তলা। তাতেই ফি-রোজ বসছে দাতব্য চিকিৎসালয়। সেখানে আরও দুটি তল করার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর। প্রথম তলে থাকবে হাসপাতাল। দ্বিতীয় তলে তিনি করতে চান বৃদ্ধাশ্রম। যদিও বৃদ্ধাশ্রম শব্দটি তাঁর পছন্দ নয়। তবু যাদের ছেলে-মেয়ে নেই, কিংবা ছেলেমেয়ে মারা গিয়েছেন, তাঁদেরই একমাত্র তিনি সেখানে ঠাঁই দেবেন বলে ঠিক করেছেন। এখনই ১৭ জন বৃদ্ধা জোগাড় হয়ে গিয়েছে তাঁর। তাদের থাকা খাওয়ার সমস্ত দায়িত্ব করিমুলবাবুর। পাশাপাশি একদম উপরের তলে তিনি অতিথিশালা করতে চান। যাঁরা লাটাগুড়ি-গরুমারা ঘুরতে আসবেন, তাঁরা ওই অতিথিশালায় থাকতে পারেন। এতে বাইরের হোটেল-রিসর্ট এর চেয়ে কম ভাড়ায় থাকতে পারবেন যে কোনও লোক। এই অর্জিত টাকা ব্যয় হবে তাঁর হাসপাতালের জন্য।

অ্যাম্বুলেন্স দাদাকরিমুল হকের জীবন এবার স্থান করে নিতে চলেছে সেলুলয়েডে। করিমুল হকের জীবন নিয়ে তৈরি হবে বায়োপিক। ইতিমধ্যেই মুম্বই থেকে তাঁর বাড়িতে এসেছিলেন পরিচালক। চুক্তি পর্ব সেরেছেন তাঁরা। এবার গবেষণার পর কাজ শুরু হওয়ার অপেক্ষা। জীবনীনির্ভর ছায়াছবিটি পরিচালনা করবেন বিনয় মুদগলে। আনুমানিক ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকা বাজেট ধরা হয়েছে বায়োপিকটির জন্য।

অভাবের তাড়নায় বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। পড়েছেন ক্লাস ফাইভ সিক্স অবধি। তিনি বলেন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা বড় কথা নয়, মানুষের পাশে থাকা, মানুষের হয়ে কাজ করাটাই বড় কথা। যে শিক্ষা মানুষের জন্য কিছু করতে শেখায় না সে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজের লাভ কী? দেশ চায় দেশের জন্য করুক মানুষ।

তিনি বাংলা ও বাঙালির গর্ব। তিনি জাত-পাত-ধর্ম-বর্ন নির্বিশেষে মানুষের সেবা করে চলেছেন। তাকে কুর্নিশ জানাই।




No comments