Header Ads

অগ্নিযুগের বিস্মৃত দেশপ্রেমিক

১৯২৯ সালের ৮ ই এপ্রিল। নতুন দিল্লীর কেন্দ্রীয় সংসদ ভবন। দৈনন্দিন কাজে সকলে ব্যস্ত। পাবলিক সেফটি বিল নিয়ে আলোচনা চলছে। উপস্থিত স্বয়ং মতিলাল নেহেরু এবং স্পিকার বিটালভাই প্যাটেল। হঠাৎ আবির্ভাব হল অপরিচিত দুই দামাল যুবকের। তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ কোটের পকেট থেকে এক বান্ডিল ইস্তেহার ছড়িয়ে দিল। দুজনের মুখেই “ইনকিলাব জিন্দাবাদ”। পরমুহূর্তেই কেঁপে উঠলো সংসদ ভবন। পরপর পড়ল দুটি বোমা। বোমাটি বর্জ্রের মতো ভয়ংকর শব্দে ফেটে পড়ল। হলঘরে তখন শুধু ধোঁয়া। সব মিলে এলাকাটা যেন পরিণত হলো এক দক্ষযজ্ঞে ! পরিকল্পনা মাফিক বোমা দুটি এমন জায়গায় ফেলেন ওই দুই যুবক, যাতে কারও কোনও ক্ষতি না হয়, আবার তাদের কার্যসিদ্ধিও হয়।


সেদিনের সেই বোমা বিস্ফোরণের সাক্ষী ছিলেন বি এম কাউল। তিনি মাঝেমধ্যেই আইনসভায় যেতেন মতিলাল নেহেরু, পণ্ডিত মালব্য , জিন্নার বক্তব্য শুনতে। সন্দেহের বসে আটক হলেন কাউল সহ অনেক নিরীহ মানুষ। কিন্তু দোষ স্বীকার করে শান্তভাবে গ্রেফতার বরণ করেন ওই দুই যুবক। ছাড়া পান বাকিরা। ব্রিটিশ যখন বিপ্লবী যুগলকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে গর্বের সাথে তা দেখেছিলেন কাউল। 

১৯৬৫ সালের জুলাই মাস। দিল্লীর একটি হাসপাতালে চূড়ান্ত অবহেলায় লোকচক্ষুর অন্তরালে নিতান্ত অবহেলায় অর্থাভাবে পড়ে আছেন তিনি। রাজনীতির রুই কাতলা দুরস্থান, চুনো পুঁটিদেরও দেখা পাওয়া যায়নি সেদিন। কিন্তু দেখা করতে এসেছিলেন কাউল। তখন তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী, লেফট্যানেন্ট জেনারেল। পুরো নাম ব্রিজমোহন কাউল।

আপনাকে আমি কি সাহায্য করতে পারি বলুন !
ব্রিটিশের ত্রাস সৃষ্টিকারী সেই মানুষটি একটু হাসলেন !
আমি কারোর কাছে নিজের জন্যে কিছু চাই না !

বেঁচে ছিলেন আর কয়েকটা দিন। ১৯৬৫ সালের ২০ শে জুলাই তিনি পরলোকগমন করলেন ! তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুসারে অন্ত্যেষ্টি হয়েছিল পঞ্জাবের ফিরোজপুরের হুসেইনিওয়ালায়। যেখানে ৩৪ বছর আগে রাতের অন্ধকারে শতদ্রুর জলে গোপনে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর সেদিনের সেই সহযোগীর অস্থি। 

মাস খানেক আগের কথা। দিল্লিতে সফদরজং বিমানবন্দরের উল্টোদিকে হাঁটছিলাম। দুপুর বেলা।

হঠাৎ চমকে গেলাম। চোখে পড়ল বি.কে দত্ত কলোনি। দিল্লির বুকে এক বঙ্গসন্তানের নামে কলোনি। না এই মানুষটি হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে, বর্তমান প্রজন্ম তাঁকে চেনে না। ইতিহাস বইতে পুরো একটা লাইনও যে বরাদ্দ নেই তাঁর জন্যে ! অথচ সংসদ ভবনে সেদিন তাঁর সতীর্থ ভগত সিংকে গোটা ভারতবর্ষের মানুষ সেলাম জানায়। তিনি আর কেউ নন ভগতের প্রাণের প্রিয় বন্ধু বিকে ওরফে বটুকেশ্বর দত্ত। 

বটুকেশ্বর দত্ত। জন্ম ১৯১০ সালের ১৮ নভেম্বর বর্ধমান জেলার খন্ডঘোষ থানা এলাকার ওঁয়াড়ি গ্রামে। বাবা গোষ্ঠবিহারী দত্ত। অভাবের সংসার। বাবার কর্মসূত্রে ছোটবেলায় উত্তরপ্রদেশের কানপুরে পাড়ি দেন বটুকেশ্বর। ভর্তি হন কানপুরের পিপিএম হাইস্কুলে। পড়াশুনোয় কোনদিনই বিশেষ মনোযোগ ছিল না। সংস্পর্শে আসেন বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদ ও ভগৎ সিং-এর। দীক্ষিত হন বিপ্লবের মন্ত্রে। মূলধন বলতে শুধু আবেগ আর সাহস। দেশের জন্য কিছু করতে হবে, তাতে মরতে হলে হবে। হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সক্রিয় সদস্য হন। কালে কালে দলে বোমা বানানোয় বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন বিকে। 

দেশ জুড়ে সশস্ত্র বিপ্লব রুখতে ব্রিটিশ সরকার ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯১৫ চালু করার কথা ভাবছে। চলছে ভয়ঙ্কর দমন পীড়ন। তারই প্রতিবাদে ভগত্ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত পরিকল্পনা মোতাবেক দুটি সাধারণ বোমা ফেলেন সংসদ ভবনে। ফরাসী নৈরাজ্যবাদী বিপ্লবী বৈলেয়ন্টের মতোই ভগৎ সিংহের বক্তব্য ছিল 'বধিরকে শোনাতে উচ্চকণ্ঠ প্রয়োজন'। এরপর শান্তভাবে গ্রেফতার হন তারা।

গ্রেফতারের পর বিস্ফোরক আইন ও হত্যা প্রচেষ্টার দায়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার নামে প্রহসন করে ব্রিটিশ সরকার। বিচারে বটুকেশ্বরকে আন্দামানে দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়। 

দশ ফুট বাই আট ফুট সেলে রাখা হল তাঁকে। চললো নির্মম অত্যাচার। নারকেলের ছোবড়া থেকে দড়ি পাকানো, ঘানি চালিয়ে তেল নিষ্কাশন, বই বাধাঁই, ঝাড়ু তৈরি এরকম অনেক কষ্টসাধ্য কাজ করতে হত। একটি কলুর বলদ সারাদিন ঘানি ঘুরিয়ে যেখানে আটসের তেল বের করতে পারে সেখানে বটুকেশ্বরদের বের করতে হতো এক মণ তেল। না পারলে কঠিন শাস্তি পেতে হতো। আর খাবার হিসেবে সকালে জুটতো দু হাতা কঞ্জি (কঞ্জি মানে গরম জলে চালগুড়ো সেদ্ধ)। দুপুরে এক বাটি ভাত, দুটো রুটি, অড়হর ডাল আর মাঝেমধ্যে কচুপাতার তরকারি।

শরীর ভাঙলো বিকের। যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত হলেন। আন্দামান থেকে যখন ফিরে আসেন, দেশ জুড়ে প্রতিহত সশস্ত্র আন্দোলন। তাঁর কমরেডরা কেউ আর নেই। কিন্তু বিপ্লব তাঁর রক্তে। তিনি যোগ দিলেন গান্ধীজির ভারত ছাড়ো আন্দোলনে। আবার চার বছরের কারাদণ্ড হল। এবার গেলেন বিহারের মোতিহারী কারাগারে। 

বহু প্রতীক্ষিত দেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পেরেছিলেন বটুকেশ্বর দত্ত। ১৯৪৭ সালে বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রী ছিলেন অঞ্জলি। একমাত্র মেয়ের নাম রেখেছিলেন ভারতী। কিন্তু বেঁচে থাকতেই বিকেকে ভুলে গেছিল ‘স্বাধীন’ ভারত। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁর খোঁজ রাখেনি নতুন দেশের কর্তা ব্যক্তিরা। বাকি জীবন কেটেছিল দুঃসহ দারিদ্র্যে। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে পরিবহণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হন। কিন্তু ব্যর্থ হন। তার আগে একধিকবার সরকারের কাছে একটি চাকরির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি তৎকালীন সরকার। শেষ দিনগুলো ছিলেন বিহারের পাটনায়। 

তাঁর মত এমন যে কত নাম-না -জানা, না-দেখা, না-চেনা... যাঁরা অগ্রপশ্চাৎ ভাবেননি দেশের জন্য হাসতে হাসতে জীবন বাজি রাখার আগে, যাঁদের ছিল না অমরত্বের প্রত্যাশা, ছিল না ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়ার সুপ্ত বাসনা। যাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে ধারাবাহিক কার্পণ্য করেছে ইতিহাসও। প্রত্যাশিত পরিণাম, বিস্মৃতি।

কেউ মনে রাখেনি, কেউ মনে রাখে না ?

আশার আলো -

১. বিপ্লবীর কন্যা সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা ভারতী বাগচি দীর্ঘ দিন ধরেই চাইছিলেন তাঁর বাবার জন্মস্থানকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হোক। এই বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা তথা বটুকেশ্বর দত্ত স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির সম্পাদক মধুসুদন চন্দ। দীর্ঘ বছর ধরে কোনও মানুষ বাস না করায় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছিল ওঁয়াড়ি গ্রামের এই স্মৃতি বিজড়িত মাটির দোতলা বাড়িটি। ৮৪ লক্ষ টাকা খরচ করে এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে পর্যটন দফতর। ইতিমধ্যে ৪২.৫০ লক্ষ টাকা পাওয়াও গেছে বলে জানান তিনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী পুরনো বাড়িটিকে সংস্কারের পাশাপাশি ওখানে একটি মিউজিয়াম তৈরী করার কাজও চলছে। থাকছে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থাও। ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তের দুটি ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তিও বসান হবে বাড়িটির সামনে।

২. ১৭৬০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সত্তর জন স্বাধীনতা সংগ্রামী আড়াই ফুট বাই দেড় ফুট ফ্রেমে বন্দি হয়ে দিল্লি বিধানসভার সুদীর্ঘ দেওয়াল আলোকিত করে রয়েছেন৷ মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ঘরের ঠিক পাশেই রয়েছে বটুকেশ্বর আর বসন্ত বিশ্বাসের ছবি। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো বটুকেশ্বর দত্তর ছবি থেকেই বিধানসভার ‘শহিদ দেওয়াল’ শুরু ৷ গুরু দর্শন সিং বিনকালের হাতে এই সত্তরটি চিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। উদ্বোধন হয়েছে গতবছর স্বাধীনতা দিবসে।

No comments