Header Ads

ভারতের প্রথম কীট-পতঙ্গের বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য || প্রথম পর্ব


কীটপতঙ্গের সংখ্যা মানুষের সংখ্যার চেয়েও বেশি। একটা বইয়ে পড়েছি যে, কলিযুগে কীটপতঙ্গের সংখ্যা মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশি হবে। পৃথিবীর সর্বত্রই যেমন জীববৈচিত্রে ভরা আমাদের বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাতেও রয়েছে হরেক রকম সব কীটপতঙ্গের দল। অথচ, বাংলার কীটপতঙ্গ নিয়ে তেমন সুন্দর বইয়ের অভাব বহুদিন ধরেই ছিল। শুধু কীটপতঙ্গই নয়, বহুদিন গবেষণার এমনকি বাংলা সাহিত্য জগতে সাপ-ব্যাঙ সহ বিভিন্ন সরীসৃপ ও উভচর প্রাণিরাও বঞ্চিত ছিল। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও স্বনামধন্য বাংলা বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম পথপ্রদর্শক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর এই সম্পর্কে একটি আক্ষেপের কথা তুলে ধরা হচ্ছে এখানেঃ-

"বাঙ্গলার মাটিতে এবং বাঙ্গলার জলে, বাঙ্গলার গ্রামে ও বাঙ্গলার বনে যে সকল পশুপাখী, সাপ-ব্যাঙ, মশা-মাছি পোকা-মাকড় আহার বিহার করিতেছে, তাহাদের বিশিষ্ট বিবরণের জন্য, তাহাদের আহার বিহারের প্রথা জানিবার জন্য আমরা কি কেবল বিদেশী শিকারীর মুখাপেক্ষা করিয়াই থাকিব?"


সত্যি তো, আমাদের বাংলার জীববৈচিত্র জানবার জন্য কেন 'বিদেশী শিকারী'দের 'মুখাপেক্ষা'-র অপেক্ষা করতে হবে? কেন সেসব কথা কেবলমাত্র জানতে হবে ইংরেজির মত বিদেশি ভাষায়? কেন এই বিষয়গুলি নিয়ে বাংলা ভাষায় সেরকম চর্চা হবে না? এই প্রশ্নগুলোই হয়তো ত্রিবেদী মহাশয়ের মাথায় এসেছিল আর তাই তিনি উপরের কথাগুলি যথার্থভাবে বলেছেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর আক্ষেপের মধ্যে যেন বাঙালি পাঠক সমাজেরও আক্ষেপ প্রতিফলিত হয়েছে। আর তাঁর এই আক্ষেপ, বলাবাহুল্য বাংলা সাহিত্য তথা বিজ্ঞান সাহিত্য জগতের এই অভাব পূরণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন এক কিংবদন্তি বাঙালি কীটপতঙ্গবিদ, জীববিজ্ঞানী তথা প্রকৃতিবিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। ১লা আগস্ট (অর্থাৎ আজকের দিনে) ১৮৯৫ সালে অখণ্ড বাংলার ফরিদপুর (যা বর্তমান বাংলাদেশের শরীয়তপুর নামে পরিচিত) জেলার লোনসিং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর তাই এ বছর তাঁর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে শুরু হল তাঁকে নিয়ে এই ধারাবাহিক। 

গোপালচন্দ্রের বাবার নাম অম্বিকাচরণ ভট্টাচার্য ও মায়ের নাম শশীমুখী দেবী। গোপালচন্দ্ররা ছিলেন চার ভাই যাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়ো। তাঁর মেজ ভাইয়ের নাম নেপালচন্দ্র, আর ছোট দুই ভাই ছিলেন যমজ। যাঁদের নাম পঙ্কজবিহারী ও বঙ্কিমবিহারী। গোপালচন্দ্রের বাবা খুব কষ্ট করেই সংসার চালাতেন, দারিদ্রতার সাথে নিরন্তর লড়াই করে। দুঃখের বিষয় গোপালচন্দ্রের যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়স তখন তিনি পিতৃহারা হন। তাঁর মা শশীমুখী দেবী অথৈ জলে পড়লেন তাঁদের সংসার নিয়ে। একই সব ছেলেরা তখন বেশ ছোট। তাঁকে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তবুও তিনি শক্ত থেকেছেন, অবিচল থেকেছেন, ভেঙে কখনো পড়েননি। একা হাতে সংসার সামলে সন্তানদের মানুষ করেছেন। বড়ো ছেলে গোপালচন্দ্রকে তখন তিনি স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। গোপালচন্দ্র পড়াশোনায় অত্যন্ত কৃতী ছাত্র ছিলেন। প্রতি ক্লাসে প্রথম হতেন। তিনি শুরুতে বাড়ির কাছাকাছি একটি পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে কিছুদিন পড়ে ভর্তি হন লোংসিং হাই স্কুলে।ছেলেবেলা থেকেই গোপালচন্দ্র খুব কষ্ট করেই পড়াশোনা করেছিলেন। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে সংসারের হাল ধরতে হবে তো! মাতা শশীমুখী দেবী তাঁর এই শিশুপুত্র গোপালচন্দ্রকে একেবারে অল্প বয়সেই পৈতে দিয়ে যজমানি রক্ষা করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তাই ছোটবেলায় পৈতে নিয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য বাড়ি-বাড়ি গিয়ে পুরোহিতের কাজ করতেন। আর তার জন্য তাঁকে সকালবেলাতেই বেরিয়ে পড়তে হতো। 

বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ থেকে প্রকাশিত 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকার ৩৪ তম বর্ষ ১১শ গোপালচন্দ্রের ভাই পঙ্কজবিহারী ভট্টাচার্য তাঁর দাদার রোজকার এই কষ্টের কথা তুলে ধরেছেন- "...বড়োদা সেইসব খাল বিল ডোবা পেরিয়ে যজমানের বাড়িতে পৌরহিত্য করে বাড়িতে ফিরে কিছু মুখে গুঁজেই স্কুলে ছুটতেন।" এভাবেই, গোপালচন্দ্র কঠোর পরিশ্রম করেই পুরোহিতের কাজের পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে গেছেন। ১৯১৩ সালে গোটা ফরিদপুর জেলায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে গোপালচন্দ্র ম্যাট্রিক (এখনকার মাধ্যমিক) পাস করেন। মা শশীমুখী দেবী ছেলের এই অভাবনীয় সাফল্যে খুব খুশি হয়ে বললেন, "ভালো ফল করেছো। কলেজে ভর্তি হও।" মাতৃআজ্ঞা পালন করেই তিনি ১৯১৪ সালে ভর্তি হলেন ময়মনসিংহ জেলার আনন্দমোহন কলেজে। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, সেই বছরেই গোটা বিশ্ব জুড়ে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধের বীভৎসতা, ভয়াবহতা সারা মানব সমাজে সেই প্রথম দেখা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাব থেকে সেদিন পরাধীন ভারতবর্ষও রেহাই পায়নি।জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গিয়েছিল। এদিকে কলেজজীবন শুরুর সাথে সাথেই গোপালচন্দ্র সংসার জীবনও শুরু করেছিলেন। তিনি বিবাহ করেছিলেন লাবণ্যময়ী দেবীকে। তা, ওই অবস্থায় পড়াশোনা চালানো এক দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। অতএব, কৃতী ছাত্র গোপালচন্দ্রের পড়াশোনা আর এগোল না। গোপালচন্দ্র মনের ব্যথায় বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। তবে, খুব বেশিদিন ঘরে বসে থাকতে হয়নি তাঁকে। ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে ফরিদপুরের পণ্ডিতসার স্কুলে চাকরি পেলেন। আসলে, সংসার চালাতেই স্কুল শিক্ষকের চাকরি নিতে হয়েছিল তাঁকে। সেখান প্রায় দু’বছর পড়িয়ে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর নিজের স্কুল অর্থাৎ লোনসিং হাইস্কুলে মাস্টারির চাকরি পান।
(চলবে)


No comments