Header Ads

ভারতের প্রথম চলচ্চিত্রের জনক হলেন হীরালাল সেন, দাদাসাহেব ফালকে নয়



ভারতে প্রথম চলচ্চিত্রের বিকাশ ঘটেছিল হীরালাল সেন ও মতিলাল সেনের কোম্পানি 'দ্য রয়্যাল  বায়োস্কোপ' এর হাত ধরে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পাদ্রি ফাদার লাফোঁ লুমিয়ের ব্রাদার্সের কাছ থেকে একটি সিনেমাটোগ্রাফার আনান এবং তিনি প্রথম একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন, যদিও তা শুধুমাত্র সেন্ট জেভিয়ার্সের ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ ঘটনার কিছুদিন পরেই ১৮৯৬ সালে 'স্টার থিয়েটার' কর্তৃপক্ষ হৈ চৈ সৃষ্টি করে তাদের হ্যান্ডবিল প্রচারের মাধ্যমে। ওনারা প্রচার করেন-

          ‘পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য! বায়োস্কোপ! 
                 আসুন! দেখুন!
           যাহা কেহ কখনও কল্পনা করেন নাই 
         তাহাই সম্ভব হইয়াছে। ছবির মানুষ, জীবজন্তু জীবন্ত
         প্রাণীর ন্যায় হাঁটিয়া ছুটিয়া চলিয়া বেড়াইতেছে..’

এই বায়োস্কোপ আসার পর চলমান দৃশ্যের সাথে পরিচিত হয় কলকাতার মুস্টিমেয় কিছু অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ যা শুধু তাদের কাছেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই যন্ত্র দেখে হীরালাল সেন আগ্রহী হন এবং যন্ত্রটি তিনি আনিয়ে নেন। যদিও তখন কলকাতার মাত্র দুই জায়গায় ইলেকট্রিক ছিল, যার ফলে এই যন্ত্র খুব একটা কার্যকরী ছিল না। হীরালাল সেন তখন রবারের ব্যাগে চুনকে অক্সিজেনে পুড়িয়ে লাইমলাইটের মাধ্যমে বায়োস্কোপ তিনি বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতে সমর্থ্য হন, যদিও এই রবারের ব্যাগ খুব তাড়াতাড়িই নষ্ট হয়ে যেত যার ফলে তিনি খুব সমস্যায় পড়েন। ভারতে যিনি প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেছিলেন সেই ফাদার লাফোঁর তিনি স্মরণাপন্ন হয়ে তিনি এই ব্যাগটি একবার সারিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি দেখেন যে স্টিফেন সাহেব একটি বাক্সের মতো যন্ত্র ব্যবহার করতেন।এই বাক্সের ব্যাপারে জানতে চান হীরালাল সেন কিন্তু এই ব্যাপারে তিনি সাহায্য পাননি। এরপর তিনি নিজেই এই যন্ত্রটি বানিয়ে নেন। এরপর মতিলাল সেনকে নিয়ে তিনি 'সেন ব্রাদার্স' বায়োস্কোপ কোম্পানি খোলেন। পরে এই কোম্পানির নাম দেন 'রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি'। যার মাধ্যমে বাংলা, বিহার, আসাম ও ওড়িষ্যার গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে বায়োস্কোপকে ছড়িয়ে দেন এই দুই ভাই। হীরালাল সেন বহু নাটককেই সেলুলয়েডে অমর করতে সমর্থ্য হন। 'আলিবাবা', 'সীতারাম', 'ভ্রমর', 'বধূ', 'হরিরাজ', 'দোলয়াত্রা' এরকম বহু নাটকের নির্বাচিত বিভিন্ন চলমান দৃশ্য তিনি রেকর্ড করেন। ১৯০০-১৯১৭ এর মধ্যে ৪০ টি ছায়াছবি করান হীরালাল সেন। এভাবে চলচ্চিত্রকে তিনি জনপ্রিয় করে তোলেন। 

দাদা সাহেব ফালকেকে চলচ্চিত্রের জনক বলা হয় কিন্তু বাস্তবে হীরালাল সেনই হলেন ভারতীয় সিনেমার জনক। ১৯০০ সালের ২ রা ফেব্রুয়ারি হীরালাল সেন ও মতিলাল সেন নিখিল ভারত শিল্প প্রদর্শনীতে বায়োস্কোপ দেখান। তারপর থেকে বিভিন্ন রাজ বাড়িতে ওনাদের ডাক পড়তে শুরু করে। ভাওয়াল রাজা, মহারাজা যতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বনেলির রাজবাহাদুর এরকম বহু পরিবার ও বিভিন্ন বিদেশী থিয়েটারে ওনাদের ডাক পড়তে থাকে। তারপর হীরালাল সেন ও মতিলাল সেনকে দেখে নারায়ণ বসাক 'লন্ডন বায়োস্কোপ', প্রমথনাথ গাঙ্গুলী 'ওরিয়েন্টাল বায়োস্কোপ', সত্যচরণ ঘোষ  'বেঙ্গল বায়োস্কোপ', অনিল চ্যাটার্জী 'ইম্পিরিয়াল বায়োস্কোপ' কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সবচেয়ে বড় কথা হল এই প্রত্যেকটি মানুষের হাতেখড়ি হয়েছিল হীরালাল সেনের সাহায্যেই। কেউ রয়্যাল বায়োস্কোপে কাজ শিখেছিলেন তো কেউ আবার ওনার কাছ থেকে মেশিনের সাহায্য নিয়েছেন। হীরালাল সেন নিঃস্বার্থ ভাবে সকলকে সাহায্য করেছিলেন। সুতরাং একথা নিসন্দেহে বলা যায় ভারতে সিনেমার প্রসার ঘটিয়েছেন হীরালাল সেন। এগুলো সব হয়েছে ১৯০৩ এর আগে। যেখানে দাদাসাহেব ফালকে প্রথম ফিল্ম বানান ১৯১৩ সালে। তাহলে প্রশ্ন হলো তিনি কিভাবে ভারতীয় সিনেমার জনক হলেন? 

১৯০৪ সালের ২৩ শে জানুয়ারী ক্লাসিকে 'আলিবাবা চল্লিশ চোর' প্রদর্শিত হয়। সুতরাং ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম দিন হলো ১৯০৪ সালের ২৩ শে জানুয়ারী। কিন্তু তার ৯ বছর পর প্রদর্শিত হয় নির্বাক ছবি 'রাজা হরিশচন্দ্র'। কিন্তু তা সত্বেও ১৯১৩ সালকেই চলচ্চিত্রের প্রথম বছর ধরা হল কিন্তু ১৯০৪ কে নয়। দাদাসাহেব ফালকে পুরষ্কার চালু হলেও হীরালাল সেনের নামে কিছুই চালু করা হয়নি।

শুধু চলচ্চিত্র ছায়াছবিই নয়, ভারতের প্রথম বিজ্ঞাপন ফিল্ম ও রাজনৈতিক ছায়াছবি বানান হীরালাল সেন। বটকৃষ্ণ পালের ঔষধ কোম্পানির একটি পেটেন্ট 'অ্যাডওয়ার্ডস ম্যালেরিয়া স্পেসিফিক' এর বিজ্ঞাপন ফিল্ম তিনি নির্মাণ করেন। তারপর সি.কে. সেনের জবাকুসুম বিজ্ঞাপন ফিল্মও তিনি নির্মাণ করেন অর্থাৎ তিনি ভারতীয় বিজ্ঞাপন ফিল্মেরও জনক। এই কাজগুলি তিনি করেছেন ১৯০৫ সালের আগেই। ১৯০৫ সালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে 'অ্যান্টি পার্টিশন ডে' এর ডাক দেন। হীরালালের রয়্যাল কোম্পানির হয়ে জ্যোতিষচন্দ্র সরকার সেই শোভাযাত্রার ছবি তোলেন। যেটি ছিল ভারতের প্রথম রাজনৈতিক ছায়াছবি।

হীরালাল সেনের 'আলিবাবা' সম্পূর্ণ নাকি খন্ডচিত্র তা জানা যায়নি। যদি তা সম্পূর্ণ চিত্র হয় তাহলে তা হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম কাহিনীচিত্র 'The Great Train Robbery' এরও আগে হয়েছিল। সেক্ষেত্রে শুধু ভারত নয় বিশ্বের প্রথম কাহিনীচিত্রের জনক ছিলেন হীরালাল সেন-ই। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক আদুর গোপালকৃষ্ণন তাঁকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে উল্লেখ করেন যদিও তা স্বীকৃতি পায়নি।

হীরালাল সেনের কাহিনীচিত্রের দৈর্ঘ্য ছিল ৫০ থেকে ২৫০০ ফুট। তাই হীরালাল সেনের ছবিগুলি যে পূর্নাঙ্গ ছিল তা বলাই বাহুল্য। ১৯০০ থেকে ১৯১৭ এর মধ্যে হীরালাল সেন ৪০ টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এবং ১৯১৩ তে প্রথম সিনেমা নির্মাণ করেন দাদাসাহেব ফালকে, তাহলে প্রশ্ন হল ১৩ বছর আগের থেকে হীরালাল সেন সিনেমা বানিয়েও জনক হলেন না, যা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অর্থাৎ দাদাসাহেব যখন সিনেমা বানাচ্ছেন তার বহু আগেই ভারতীয় সিনেমার প্রসার ঘটে গেছে, সুতরাং দাদাসাহেবকে কোনোভাবেই ভারতীয় সিনেমার জনক বলা যায় না। দাদাসাহেবের কাজকে ছোটো করা যায়না উনি অবশ্যই ভারতীয় সিনেমার পথিকৃৎ। তবে জনক বলাটা মনে হয় ঠিক নয় কারণ এক্ষেত্রে হীরালাল সেনের কৃতিত্বকে অমান্য করা হয়।


তথ্যসূত্র- কুড়িয়ে বাড়িয়ে-কৌশিক মজুমদার, আনন্দবাজার

No comments