Header Ads

মেদিনীপুরের নিজস্ব শিল্প গয়না বড়ির জিআই পাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা


মেদিনীপুরের একান্ত নিজস্ব শিল্পকর্ম হলো 'গয়না বড়ি'। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক, মহিষাদল, কাঁথি এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার বহু বনেদি পরিবারের বাড়ির মেয়েরা গয়না বড়ি তৈরি করে। আদি থেকে আধুনিক, বিভিন্ন পর্বের বাংলা সাহিত্যেও গয়না বড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও স্থানীয় লোকাচার, গাথা ও ছড়াতেও এই গয়না বড়ির উল্লেখ পাওয়া যায় যেমন "খুকুমণি কেন ভারি/ পাতে নেই যে গয়না বড়ি।"


দুই মেদিনীপুরের অতি প্রাচীন এক শিল্পকর্ম হলো 'গয়না বড়ি'। যা দেখলে বাড়িতে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করবে সকলের। বড়ির মধ্যে গয়নার সূক্ষ্ম কারুকার্য এককথায় প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়ার মতো। বিউলির ডাল, পোস্ত বেটে নানান মশলার মিশেল পাউচে ভরে হাত ঘুরিয়ে চলেন মহিলারা৷ তাতেই রূপ পায় গয়না বড়ি। অনেকে তো একে আবার নকশা বড়িও বলে থাকেন। গয়না বড়ি যে খেয়েছে সেই জানে তার স্বাদের কথা। শীতের দিনে পাতে গয়না বড়ি খাওয়ার মজাই আলাদা। 
 
বাংলার বিশিষ্ট মনীষীগণ প্রশংসা করেছেন এই গয়না বড়ির। ১৯৩০ সালে সেবা মাইতি নামে শান্তিনিকেতনের এক ছাত্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তার মা হিরন্ময়ী দেবী ও ঠাকুমা শরৎকুমারী দেবীর তৈরী গয়না বড়ি উপহার দেন। রবীন্দ্রনাথ গয়না বড়ির শিল্পকলা দেখে এতোটাই আকৃষ্ট হন যে তিনি গয়না বড়িগুলোর আলোকচিত্র শান্তিনিকেতনের কলা ভবনে সংরক্ষণ করার অনুমতি চেয়ে হিরণ্ময়ী দেবী ও শরৎকুমারী দেবীকে চিঠি লেখেন। এর ফলে গয়না বড়ি চারুকলার নিদর্শন হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে৷ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার গয়না বড়িকে কেবল নিছক শিল্প বলেই মনে করতেন, গয়না বড়ি রান্না করা বা খাওয়াকে শিল্পকর্ম ধ্বংসের কারণ হিসেবে তিনি দেখতেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলেছেন- "গহনা বড়ি কেবল দেখিবার জন্যে, খাইবার জন্য নহে।"

খাদ্যদ্রব্যের নাম ছাড়িয়ে গয়না বড়ি বর্তমানে শিল্পকর্মের রূপ নিয়েছে। নন্দলাল বসুর কথায় "নকশাগুলি সত্যিই শিল্পের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। বঙ্গমাতার ভাঙ্গা ঝাঁপিতে এই অমূল্য রত্ন সন্ধান পাইয়া আমরা মুগ্ধ হইলাম।" শীতের মরসুমে কার্ত্তিক মাসের পোড়া অষ্টমীর দিন বংশ পরম্পরায় চলে আসা কিছু কৌশল ও নিপুণ হাতের দক্ষতায় এই শিল্পকর্মের সূচনা হয়।

আধুনিক সভ্যতার চাপে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে গয়না বড়ি। পোস্তর অতিরিক্ত দাম ও বিউলি ডালের চড়া দামের ফলে মেদিনীপুরের অনেক পরিবারই বড়ি বানানো ছেড়ে দিয়েছেন। তবে কেউ কেউ গয়না বড়ির প্রাচীন ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার জন্য গয়না বড়ি বানাচ্ছেন। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অনেক মানুষই চান গয়না বড়ির ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে। দুই মেদিনীপুরের অসংখ্য মানুষ গয়না বড়ি যাতে জিআই স্বীকৃতি পায় তার জন্য লড়াই করছেন।

২০১৬ সালে আইআইটি খড়গপুর বাংলার শতাব্দী প্রাচীন নিদর্শন গহনা বড়ির জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০১৯ সালে এ রাজ্যের প্রশাসনও গয়না বড়ির জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন জানায়। সেই কাজ এখন দ্রুততার সঙ্গে চলছে। মেদিনীপুরের নিজস্ব শিল্প গয়না বড়ির জিআই পাওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments