Header Ads

গাড়ি চালক থেকে জনৈক পার্থ কর চৌধুরী হয়ে উঠেছেন 'হসপিটাল ম্যান'


সরকারি হাসপাতালের রোগীদের পাশে থাকতে হয় তাদের বাড়ির লোকেদের। দিনভর রোগীর চিকিৎসার পিছনে এদিক ওদিক ছোটাছুটিতে তাদের আর খাওয়ার সময়টুকু মেলে না৷ চিকিৎসা ব্যয়ে জর্জরিত অনেক পরিবারের বাইরে খাবার কিনে খাওয়ারও সামর্থ্য থাকে না। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যায় রোগীর পরিবারকে খাবার জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা হাসপাতালের পক্ষে সম্ভবপর হয়না। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রোগীর খাবার থেকেই ভাগ নিচ্ছেন পরিবারের মানুষজন৷ এতে রোগীর পুষ্টির ব্যাঘাত ঘটে।    


সরকারি হাসপাতালে হতদরিদ্র পরিবারের রোগীদের বাড়ির লোক ও আত্মীয়দের অভুক্ত অবস্থায় থাকার এই জটিল সমস্যাটি নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাট এলাকার মহামায়া লেনের বাসিন্দা বছর পঞ্চাশের পার্থ কর চৌধুরী। যিনি পেশায় একজন গাড়ি চালক। তিনি পাঁচ বছর ধরে একটানা ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে নিজস্ব খরচে তিনটি সরকারি হাসপাতালের সামনে রোগীর পরিবারের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দিয়ে হয়ে উঠেছেন 'হসপিটাল ম্যান'।

পার্থবাবু তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। কষ্ট করে সংসার চালালেও তাঁর মনের জোর অসম্ভব। গাড়ি চালিয়েও অনাত্মীয়দের খাওয়ানোর কাজটি করছেন৷ ঘড়িতে রাত দশটা হলেই রোগীর বাড়ির লোক ও আত্মীয়দের চোখ চলে যায় এসএসকেএম হাসপাতালের বাইরে। সেখানে দেবদূতের মতো উপস্থিত হন পার্থবাবু৷ বছরের ৩৬৫ দিনই তাঁর দেখা মেলে। হাসিমুখে মনের আনন্দে তাঁদের হাতে তিনি তুলে দেন ভাত, ডাল, রুটি, তরকারি ও বিস্কুট। কেবলমাত্র তিনি রোগীর পরিবার-আত্মীয়দের কাছেই নয়, হাসপাতালের নব্য চিকিৎসকদের কাছেও তিনি 'হসপিটাল ম্যান'।

সামান্য মারুতি চালিয়ে প্রত্যহ প্রায় দেড় হাজার মানুষের খাবার কীভাবে নিখরচায় তুলে দিচ্ছেন তিনি? তিনি বলেন, কেউ তাঁকে চাল-ডাল দিয়ে সাহায্য করেন। কেউ কেউ আবার সাধ্যমতো তাঁকে টাকা দিয়েও সাহায্য করেন৷ আবার মোটি সাতটি হোটেল থেকে বিনামূল্যে খাবারও আসে। তিনি অনেক রেস্তোরাঁকে বেড়ে যাওয়া খাবার বিলি করারও অনুরোধ করে থাকেন।

পার্থবাবু মনে করেন, মৃত্যুর পর কোনো মানুষই টাকাকড়ি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না। তাই মানুষের ভালোবাসা তাঁর কাছে অর্থের চেয়েও বেশি মূল্যবান। তিনি আজীবন মানুষের সেবা করতে চান। তিনি নাম-যশ-খ্যাতি কিছুই চান না। তিনি মানুষকে ভালোবেসেই এই মানবিক সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন৷ তিনি বছর ছয়েক আগে চিকিৎসার জন্য একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তিনি সেখানে নিজের চোখে দেখেছেন একটু রাত বাড়লেই হাসপাতালের সামনের খাবারের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সমস্যাটি তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন৷ পেটে প্রচণ্ড খিদে থাকলেও রোগীর পরিবার ও আত্মীয়দের কিছু করার থাকে না।  

তিনি হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর সিদ্ধান্ত নেন হাসপাতালের বাইরে থাকা রোগীর বাড়ির লোক ও আত্মীয়দের মুখে তিনি বিনামূল্যে খাবার তুলে দেবেন। বিলম্ব না করেই তিনি লেগে পড়লেন এ কাজে। প্রথম প্রথম খাবার জোগাড় করতে গিয়ে নানান সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। হাসপাতাল চত্বরে থাকা খাবারের দোকানগুলি কখনো পার্থবাবুর বিরোধিতা করেছেন৷ কখনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের সীমানা থেকে তাঁকে বের করে দিয়েছেন। কখনো পুলিশি হাঙ্গামারও শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। এমনকি কোভিড পরিস্থিতিতে হাসপাতালে যাতায়াত করতেন বলে পাড়া থেকেও তাঁকে একঘরে করে রাখা হয়েছিল। তবুও কোনো কিছুতেই দমে থাকেননি তিনি। একসময় স্কুলে মারুতি চালানোর কাজ সেরে এসেও  হাসপাতালে খাবার বিলি করেছেন তিনি। এরপর কোভিডে স্কুলের কাজ হারালেও তিনি সেবার কাজে ইতি টানেননি। তাঁর জমানো টাকা থেকেই খাবার ব্যবস্থা করতেন তিনি৷ তাঁর জমানো টাকা ফুরিয়ে গেলেও পিছু হটেননি তিনি৷ এখন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েছেন তিনি৷ ঋণের টাকাতেই বর্তমানে গাড়ির তেল, রান্নার খরচ চালান তিনি।  

পার্থবাবু ক্রাইড ফান্ডিংয়ের ওপর একেবারেই বিশ্বাসী নন। মানুষ স্বেচ্ছায় কোনো সাহায্য করলে তবেই তা তিনি গ্রহণ করেন। ভবিষ্যতে 'হসপিটাল ম্যান' সারাজীবন এভাবে রোগীর পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে কমিউনিটি কিচেন গড়ে তুলতে চান। 

কোভিড পরিস্থিতিতে কিছু দুঃস্থ পরিবারের হাতে পার্থবাবু রেশনও তুলে দেন। ২০২০ সাল থেকে তিনি নিয়মিত সাপ্তাহিক ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পও করছেন। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments