Header Ads

কলকাতায় তিনি দু'বার এসেছিলেন, মহানগর হারালো তার এক কাছের বন্ধুকে


২০০৮ এর ডিসেম্বর মাস। কলকাতা শহরে কনকনে ঠান্ডার আগমন। শীতের পারদে কাবু নগরবাসী। এরই মাঝে শহরে সাজো সাজো রব। শহরের প্রত্যেকে দূর দেশের একটা মানুষের জন্য অপেক্ষারত। সেই মানুষটি বিদেশি হওয়া সত্ত্বেও শহরের মানুষ তাঁকে আপন করে নিয়েছিল। এই মানুষটির পায়ের জাদুতে মুগ্ধ পুরো পৃথিবী। তিনি এক বিশ্ববিখ্যাত  ফুটবলার। তিনি ফুটবলের রাজপুত্র৷ এতো বড়ো মাপের একজন ব্যক্তির বাংলার রাজধানী কলকাতার মাটিতে পায়ের ধূলো পড়তে চলেছে। এটাই বা কম কী। এই খ্যাতনামা ব্যক্তিকে আলাদা পরিচয় করাতে হয়না, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন দিয়াগো মারাদোনা।


সেই প্রথমবার কলকাতায় পা রাখলেন ফুটবলের রাজপুত্র মারাদোনা। সূদুর আর্জেন্টিনা থেকে সোজা কলকাতায় এসে হাজির তিনি। ডিসেম্বরের গভীর রাতে শহরজুড়ে আবেগের বিস্ফোরণ চলছে। বিমানবন্দরে তাঁকে একঝলক দেখার জন্য ভিড় জমালেন বহু মানুষ। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ মশাল হাতে বিমানবন্দরের সামনে রাস্তাতে দাঁড়িয়েছিল। যা দেখে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। 

পরদিন সকালে কলকাতার নানান জায়গাতে মারাদোনাকে নিয়ে অনুষ্ঠান চলতে থাকে। তিনি শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের মাঠে যখন এসে উপস্থিত হলেন তখন গোটা মাঠ দিয়াগো দিয়াগো আর্তনাদে ভরে ওঠে। পুরো কলকাতা সসম্মানে তাঁকে বরণ করে নিয়েছিল৷ কলকাতা শহরের তাঁর বহু সমর্থক তাঁকে রাশি রাশি ভালোবাসাতে ভরিয়ে তোলে। কলকাতায় এসে বাংলার মানুষের আপ্যায়নে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। তাঁর জীবনস্মৃতির অধ্যায়ে গেঁথে যায় প্রথম কলকাতা সফর। 

দীর্ঘ দশ বছরের কলকাতার পুরানো স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আবারো তিনি এলেন কলকাতায়। তিনি ভালো করেই জানতেন যে এই শহরটা প্রচণ্ড ফুটবল পাগল। তিনি ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় এসে শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবে নিজের মোমের মূর্তি উদ্বোধন করতে এলেন। নিজের মোমের মূর্তি দেখে চোখ ছলছল করে ওঠে তাঁর। তিনি মাঠে বক্তব্য রাখার সময় আওড়ালেন তাঁর দশ বছর আগের কলকাতা সফরের স্মৃতি। তিনি বললেন "আমি ফুটবলের ভগবান নই। একজন সাধারণ মানুষ। দ্বিতীয়বার কলকাতায় আসতে পেরে আমি খুশি। আপনাদের এই অভ্যর্থনায় আমি অভিভূত। কখনও ভাবিনি কলকাতায় আমার মূর্তি বসবে। দুর্দান্ত ব্যাপার। এই দিনটার কথা আমি কোনোদিনও ভুলতে পারব না।" 

তিনি বল পায়ে দৌড় শুরু করলে, আবেগও দৌড় শুরু করতো। তাঁর বাঁ পায়ের জাদু যেন জীবনের কথা বলতো। বিপক্ষ রক্ষণ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করতো, তাঁর চোরা গতি আর শরীরের দোলায়। আর্জেন্টিনা একসময় তাঁর হাত ধরে নতুন করে বিশ্বকাপ জিতেছিল। গত ২৫ শে নভেম্বর এই বিষময় বছরে জীবনাবসান ঘটলো মারাদোনার। বহুদিন ধরে তাঁর মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধেছিল। তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারও চালানো হয় তবে শেষরক্ষা আর হলো না। অবশেষে হার্ট অ্যাটাকে বিদায় নিলেন মারাদোনা। 

কলকাতার মানুষ তথা গোটা বাংলার মানুষ তাঁকে আপন করে নিয়েছিল। তিনি অজস্র স্মৃতি রেখে গিয়েছিলেন কলকাতায়। ২০০৮ সালে তিনি পায়ের ছাপও দিয়েছিলেন। কলকাতায় এসে মাঠের মধ্যে তাঁর বুকের দু'পাশে তাঁর দুটো হাত চাপড়ানো ও দুই পায়ে বল নিয়ে ম্যাজিক দেখানোর সেই অভূতপূর্ব দৃশ্যটি নস্টালজিক হয়ে থেকে যাবে। সেদিনের কলকাতা শহরের মারাদোনা জ্বরের আবেগ মিশ্রিত দিনগুলো ইতিহাস হয়ে থেকে যাবে। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তিনি রোমন্থন করেছেন কলকাতার স্মৃতি। বিদায় দিয়াগো। বিদায় মারাদোনা। বিদায় ফুটবলের রাজপুত্র। মহানগর হারালো তার এক প্রাণের বন্ধুকে। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন ভালো থাকুন। পুরো কলকাতা আপনাকে আজীবন মনে রাখবে। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments