বিরাট ভগ্নস্তূপের বুকে দাঁড়িয়ে রায়পুর রাজবাড়ি উসকে দেয় ২৫০ বছরের ইতিহাস
আমাদের কথা-
আমরা স্বামী স্ত্রী দুর্গাপুরে থাকি। সাধারণ মধ্যবিত্ত। সামান্য টাকাকড়ি রোজগার করি কিন্তু স্বপ্ন দেখি বিচ্ছিরি রকমের বড়সড়! সেই স্বপ্নে প্রাসাদোপম অট্টালিকা নেই, পেল্লায় গাড়ি নেই, সাত রাজার ধন নেই। আছে ভ্রমণের স্বপ্ন! আমরা দুজনে আমার মোটরসাইকেলে করে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াই। আমার মোটরসাইকেলটি বড় ইঞ্জিনের থাম্পার নয়। নিতান্ত সাধারণ ১২৫ সি সি র হন্ডা। কিন্তু তাই নিয়ে দুর্গাপুর থেকে টানা চালিয়ে দার্জিলিং পর্যন্ত গেছি। স্বপ্ন দেখি একদিন গোটা ভারতবর্ষ দেখবো আর তারপর...! আমাদের দুটি বাচ্চা ছাড়াও একটা দর্শন আছে। আমরা বিশ্বাস করি দুটি মানুষকে দীর্ঘকাল একসাথে সুখে সংসার করতে হলে তাদের মাঝে মাঝে adventure খুঁজে নিতে হয়। চার দেওয়ালে বাঁধা পড়ে গেলেই মুশকিল। আমরা দুজনে adventure ভালোবাসি আর তাই বেরিয়ে পড়ি চেনা অচেনা পথ খুঁজে নিতে। বিশ্বাস করুন এই adventure তাড়া করে বেড়াতে গিয়ে আমাদের সামান্যই টাকা খরচ হয়। কিন্তু ঠিক এভাবেই পাতার পর পাতা ভরাট হয় আমাদের Motorcycle Diary র!
We live to Ride! We Ride to Live!
রায়পুর রাজবাড়ি-
দুর্গাপুর থেকে মোটরসাইকেলে করে বোলপুর এতবার গেছি যে রাস্তার ধারের প্রতিটা গাছ, প্রতিটা দোকান, প্রতিটা ধানক্ষেত চেনা হয়ে গেছে। দুর্গাপুর থেকে যারা বোলপুর যান তাদের জন্য বলি মলানদীঘি হয়ে যাবেন। দারুণ শর্টকাট, সবুজে ঘেরা। অকারণে পানাগড় দার্জিলিং মোড় অবধি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এক ঘন্টায় বোলপুরে পৌঁছে যাবেন। এবার আসি মূল কাহিনীতে। ২রা নভেম্বর সকালে আচমকা সিদ্ধান্ত নেওয়া হল "একটু রায়পুর রাজবাড়িটা ঘুরে আসা যাক!" হল না হয় ভগ্ন প্রাসাদ। কিছু তো একটা ব্যাপার আছে সেখানে। ভূতের সিনেমার প্রিয় লোকেশান বলে কথা! সেই ১৯৮৪ সালে মৃনাল সেন পরিচালিত হিন্দি সিনেমা "খান্ডাহার"- এর শুটিং দিয়ে বোধ করি ভূতপ্রিয়দের কাছে এই ভাঙা বাড়ির জনপ্রিয় হওয়া। তারপর এক এক করে বহু বাংলা সিনেমার শুটিং হয়েছে। রুপোলী পর্দার বহু অভিনেতাকে অন স্ক্রিন ভূতে পেয়েছে এই ভাঙা বাড়িতেই। ভূতেরা ঘাড় মটকে খেয়েছে আরও অনেককে। পুরোটাই অবশ্য ওই রুপোলী পর্দায়। আজ অবধি এতো জায়গায় গেলাম, কেউ একটা পান্ত ভূতের জ্যান্ত ছানা ধরে এনে দেখাতে পারলনি বাপ! সে যাইহোক, যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। আমাদের রাঢ় বাংলায় নভেম্বরেই শীত পড়া শুরু হয়ে যায়। দিনে শীতের আমেজ বয়ে নিয়ে আসা মৃদু বাতাস, সোনা রোদ, ধানক্ষেতের হলুদ হতে চলা ফসল, আর রাতে সোয়েটার টুপি – এই আমাদের রাঢ় বাংলার শীতের চালচিত্র। আমরা দুজনে সকাল সাড়ে নটা নাগাদ দুর্গাপুর থেকে রওনা দিয়ে দিলাম বোলপুরের দিকে। হ্যাঁ বোলপুর। কারণ রায়পুর ওখানেই।
রায়পুরের একটা ইতিহাস আছে আর তা বেশ ঝলমলে। আমরা তো এখন গুগল ম্যাপ নির্ভর জীবন কাটাই। তা ওই যন্ত্রেই রায়পুর দিয়ে খুঁজলে দেখতে পাবেন বোলপুরের উপকন্ঠেই রায়পুর-সুপুর গ্রাম এলাকা। ইলামবাজার থেকে বোলপুর-কবি জয়দেব রোড ধরে সোজা বোলপুরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে একটা জায়গায় এসে দেখতে পাবেন রাস্তাটা ইংরেজি Y এর মতো দুভাগ হয়ে গেছে। এই Y এর ঠিক আগেই রাস্তার ডান দিকে ল্যান্ডমার্ক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে বসুন্ধরা বাগানবাড়ি। অসম্ভব ভালো রান্না। আমাদের এই ট্রিপে দুপুরের খাবারটা ওখানেই খেয়েছিলাম। একেবারে চেটেপুটে পেটপুরে খেয়েছি! Y এর বাঁহাত ধরে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটা শ্রীনিকেতন রোড। রায়পুর যেতে হলে ওটা নেবোনা। ডান দিকের রাস্তা ধরে সোজা প্রায় পাঁচ কিলোমিটার মতো গাড়ি চালিয়ে গেলেই পেয়ে যাবো রায়পুর বাসস্ট্যান্ড। আর তার উল্টো দিকেই ধানক্ষেতের বুক চিরে চলে গেছে পাকা রাস্তা। একেবারে গ্রামের ভেতরে। তখন ঘড়িতে ১১টা বাজে। আমরা দুজনে মোটরসাইকেলে করে গ্রামের ভেতরে ঢুকে প্রথম যাকে দেখতে পেলাম তাকেই জিগ্যেস করলাম "ভাই রাজবাড়িটা কোথায়? যেখানে ভুতের সিনেমার শুটিং হয়?" ছেলেটি আঙুল দিয়ে রাস্তার শেষ প্রান্ত দেখিয়ে বলল "এই রাস্তা ধরে ক্লাবঘর পর্যন্ত সোজা চলে যান। ওখানেই পেয়ে যাবেন।" ছেলেটির কথা মতো আমরা সুবোধ বালক বালিকা হয়ে রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে থাকলাম। একটা জিনিস চোখে পড়ল। এ গ্রাম যেমন তেমন গ্রাম নয়। বেশ বর্ধীষ্ণু। আর হবে নাই বা কেন? এ গ্রাম কি যে সে গ্রাম? এইগ্রামের ইতিহাসকে টেক্কা দিতে পারে তেমন গ্রাম খুব বেশী নেই ভূভারতে!
গ্রামের ভেতরে আনুমানিক ১ কিলোমিটার যেতেই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। রায়পুর রাজবাড়ি! সিনেমার বিভিন্ন শটে হয়তো দেখেছেন ঘন জঙ্গল পেরিয়ে চরিত্ররা এসে হাজির হল ভগ্নপ্রায় দালানবাড়ির সামনে। তারপর তারা এক এক করে ঢুকলো বাড়ির ভেতরে এবং অচিরেই ভূত দর্শন! বাস্তবে কিন্তু তেমন কিছুই নয়। দালানবাড়িতে ঢোকার কোন প্রশস্ত পথ অন্তত আমাদের চোখে পড়েনি। রায়পুর যুব সংঘ ক্লাবের অফিস মূল জমিদার বাড়ি লাগোয়া পুরনো একতলা কাছারি বাড়িতে। বাড়িটি এখন তাদেরই তত্ত্বাবধানে। যা বুঝলাম প্রাক্তন জমিদার পরিবারের শরিকদের পক্ষে এতো বড় বাড়ি দেখাশোনা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই রায়পুর যুব সংঘ ক্লাবের সাথে এই collaboration. তাদের দেওয়া তিনটি বড় বড় নোটিস টাঙ্গানো আছে অট্টালিকার গায়ে। আপনারা গেলেই স্বচক্ষে দেখে নিতে পারবেন। নোটিসের বক্তব্য খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে যা দাঁড়ায় তা হলঃ
১. রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দালানবাড়ির অবস্থা শোচনীয়। তাই নিজের রিস্কে ঢুকুন।
২. বাড়ির ভেতরে যেকোন ধরনের অশালীন বা অসামাজিক কাজ কঠোরভাবে দমন করা হবে।
৩. এই বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে জানুন এবং তার মহিমা সম্পর্কে সচেতন হন।
৪. বাড়ির বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য ও ড্রোন শটসের জন্য অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে।
বাড়ির দেওয়ালের গায়ের একটা বড় "হাঁ" দিয়ে উঠোনে প্রবেশ করলাম। হঠাৎ মনে হল কোলকাতার লর্ড সিনহা রোডের সাথে কি অসম্ভব ফারাক! লর্ড সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিনহা – এই বাড়ির প্রতিটি ইট-পাথরে ওঁর আর ওঁর পূর্বপুরুষদের নাম গাঁথা হয়ে রয়েছে। বিরাট ভগ্নপ্রায় বাড়ির মাঝে বড় পরিষ্কার চাতাল। আর তার ঠিক মাঝে একখানি কুয়ো। এই চাতাল আর কুয়ো রুপোলী পর্দায় বিখ্যাত হয়ে গেছে। এই কুয়োর পাড়ে বসে থাকতে থাকতে আলাপ হল শান্তিনিকেতন থেকে ঘুরতে আসা বিশ্বভারতীর দুই ছাত্রের সাথে। তাদের সাথে আলাপচারিতায় উঠে এলো এই বাড়ির ইতিহাস। সিপাই বিদ্রোহের সমাপ্তি হয় ১৮৫৯ এ। তার ঠিক দুবছর পরে ১৮৬১ সালের ৭ ই মে জন্ম নেন বাঙালির ঠাকুর রবি ঠাকুর। রবি ঠাকুরের যখন মাত্র ২ বছর বয়স তখন ওঁর বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সিদ্ধান্ত নেন শহরের কোলাহল থেকে দূরে ঈশ্বর উপাসনার জন্য একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করবেন। উপাসনা স্থল হিসেবে তিনি বেছে নিলেন লালমাটির দেশ বীরভূম। ঠিক কেন বীরভূমকে বেছে নিয়েছিলেন মহর্ষি তা জানা নেই। কিন্তু এই বীরভূম জেলা যে William Wilson Hunter সাহেবকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছিল তা ওঁর পাঠকরা ভালোই জানেন। ওঁর বই Annals of Rural Bengal (1868) বইয়ে বীরভূম জেলার রূপের যে বর্ণনা উনি দিয়েছেন তা তাক লাগানো। কে এই হান্টার সাহেব? বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, সাহিত্যিক ও এদেশের একদম প্রথম ব্যাচের Civil Servant -দের অন্যতম। ১৮৫৮-এ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে ১৮৬২ তে বীরভূমের Assistant Magistrate হিসেবে নিযুক্ত হন। অতঃপর তাঁর বীরভূম প্রেম এবং এই অঞ্চলের কোলকাতার সুশীল সমাজে প্রচার পাওয়া। মন্দজনে বলে বঙ্কিমচন্দ্রের অন্তত দুটি উপন্যাস, দুর্গেশনন্দিনী ও আনন্দমঠ, হান্টার সাহেবের লেখার সরাসরি অনুবাদে সমৃদ্ধ। অন্তত লেখার প্রেক্ষাপট বর্ণনা খুঁটিয়ে দেখলে তাই মনে হয়।
সে যাইহোক, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁর আশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য বীরভূমে এসে দ্বারস্থ হলেন এই রায়পুর জমিদার বাড়ির তদানীন্তন জমিদার ভুবনমোহন সিনহার কাছে। সে সময় বর্তমান বোলপুরের একটা বড় অংশ রায়পুর জমিদার বাড়ির অধীনে ছিল। দুটি ছাতিম গাছ সমেত ২০ একর জমি মহর্ষি বাৎসরিক ৫ টাকায় (মতান্তরে ১ টাকা) দীর্ঘমেয়াদি লীজে নিলেন ভুবনমোহনের কাছে। নাম দিলেন শান্তিনিকেতন। সালটা ১৮৬৩। সিনহা বাড়িতে সেই বছরই জন্ম নিল যে শিশু, সে একদিন সারা ভারতবর্ষকে উদ্ভাসিত করবে মেধার আলোয়। সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিনহা! বাবা শ্রী সিতিকন্ঠ সিনহা। রবি ঠাকুরের থেকে ২ বছরের ছোট। শোনা যায় ভুবনমোহন যে জমি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করার জন্য মহর্ষিকে দিয়েছিলেন তার ঠিক উলটোদিকেই ছিল ওঁরই নামাঙ্কিত ভুবনডাঙ্গা। এই ভুবনডাঙ্গার আবার বেশ বদনাম ছিল ডাকাতদের গঢ় হিসেবে। শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার একেবারে শুরুর দিকে এই ডাকাতদল নাকি বেশ গোল পাকিয়েছিল। পরে মহর্ষির সান্নিধ্যে এসে তাদের মন বদলে যায়। তারা নাকি আশ্রম প্রতিষ্ঠার কাজে সাহায্যও করেছিল মহর্ষিকে। এখানে একটা ছোট্ট ঘটনা না বললেই নয়। ১৮৫১ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয় Great Exhibition – আদতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শক্তির আস্ফালন। এই Exhibition এর মুখ্য আকর্ষণ ছিল হাইড পার্কের নবনির্মিত Crystal Palace । এই স্ফটিক প্রাসাদ বা ক্রিস্টাল প্যালেসের অনুপ্রেরণাতেই মহর্ষি ১৮৬৩ তে শান্তিনিকেতনে গড়ে তোলেন বিখ্যাত উপাসনা গৃহ। শোনা যায় সেসময়েই উপাসনা গৃহটি ওই এলাকার অন্যতম প্রধান আকর্ষণে পরিণত হয়। এইসব ঘটনার সত্যতা যাচাই করা কঠিন। রায়বাড়ির ভগ্নস্তূপের মধ্যে কতো কাহিনী যে বিলীন হয়ে গেছে তার হিসেব নেই। আবার এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই জন্ম নিয়েছে অসংখ্য লোকগাঁথা। সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিনহা রবি ঠাকুরের থেকে মাত্র ২ বছরের ছোট এবং প্রায় একই রকমের বর্ধীষ্ণু পরিবারের সন্তান হলেও দুজনের জীবন সম্পূর্ণভাবে আলাদা দুটি ধারায় প্রবাহিত হল।
২৭ জানুয়ারি ১৮৭৮ – রবি ঠাকুরের তখন মাত্র ১৭ বছর বয়স। ওইদিনে তিনি প্রথমবার পা দিলেন শান্তিনিকেতনের প্রাঙ্গণে। সূচনা হল এক সুদীর্ঘ সুবর্ণ যুগের। কিন্তু সেবছর একরকম আচমকাই বাবার নির্দেশে ওঁকে ইংল্যান্ড চলে যেতে হল আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে। বলাবাহুল্য ও জিনিস তাঁর একদম পোষালো না। দেড় বছরের মাথায় ওদেশে সাহিত্য চর্চা সেরে, আইন পড়ার জলাঞ্জলি দিয়ে ফিরে এলেন বাংলায়। ১৮৮৩ তে বিয়ে করলেন ১০ বছরের মৃণালিনী দেবীকে। আর তারপরেই ১৮৯০ সালে আরও একবার বাবার আদেশে ওঁকে বেরিয়ে পড়তে হল। এবার জমিদারীর তদারকি করার কাজ জুটলো কপালে। অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, পাবনা, ও রাজশাহী থেকে একেবারে উড়িষ্যা অবধি ছুটে বেড়াতে হল। কিন্তু এর মধ্যে শিলাইদহই হয়ে উঠল ওঁর মুখ্য কর্মস্থল। এবং সাহিত্যের উপাসনার মন্দিরও বটে! কিন্তু ১৯০১ সালে আরও একাবার বাবার আদেশে ফিরে আসতে হল মহর্ষির কাছে। এবার শান্তিনিকেতনে। মহর্ষি ততদিনে বৃদ্ধ। এরই মধ্যে ১৮৮৮ সালে শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট বানিয়ে তাকেই শান্তিনিকেতনের জমি জায়গা সম্পত্তি সব দান করে দিয়েছেন মহর্ষি। ১৯০১ সালে এই নবগঠিত ট্রাস্টের হাল ধরতে হল রবি ঠাকুরকে। প্রতিষ্ঠা করলেন ব্রহ্মচর্যাশ্রম। ১৯০৫ এ মহর্ষি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত হলেন শান্তিনিকেতনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ দিতে। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পরে যেন ওঁর কাজের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। ১৯১৮ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের। আর ১৯২১ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর (৮ পৌষ, ১৩২৮) আচার্য ব্রজেন্দ্রলাল শীলের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন বিশ্বভারতীর। কিন্তু এই মহাযজ্ঞের কোন কিছুই সম্ভব হতনা রায়পুর জমিদারবাড়ির সৌজন্য ছাড়া।
রবি ঠাকুর একদিকে যখন একাধারে কবি, দার্শনিক, ও শিক্ষার দিশারী রূপে নিজেকে মেলে ধরছেন, ঠিক তখনই সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিনহা সম্পূর্ণ অন্য ধারায় দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। ১৮৭৯ সালে প্রেসিডেন্সি থেকে এফ এ পাশ করেছেন। ১৮৮০ তে গোবিন্দ মোহিনী দেবীকে বিয়ে করেছেন। আর ১৮৮১ তে রওনা দিয়ে দিয়েছেন ইংল্যান্ডে। আইন পড়তে। যে পড়া রবি ঠাকুর শেষ করতে পারেননি আগ্রহের অভাবে, সেই একই পড়া সত্যেন্দ্র শুধু যে শেষ করলেন তাই নয়, সেদেশের সুপ্রাচীন ও সুপ্রসিদ্ধ Lincoln’s Inn থেকে প্রথমে বার্ষিক ৫০ পাউন্ড ও পরে বার্ষিক ১০০ পাউন্ড বৃত্তি নিয়ে একেবারে সেরার সেরা হয়ে পাশ করলেন। ১৮৮৬ সালে হলেন ব্যারিস্টার। তারপর দেশে ফিরে কোলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করলেন আর সাথে ব্যারিস্টারি। সেই একই বছর উনি সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন। ১৯০৫ সালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে পেলেন Bengal Presidency-র Advocate General এর পদ। ১৯০৮ সালে সেই পদে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত হলেন (১৯১৬ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য এই পদ গ্রহণ করেছিলেন)। ১৯০৯ সালে প্রথম নেটিভ বা ভারতীয় মূলের ব্যক্তি হিসেবে পেলেন Viceroy এর Executive Council এর আইনি বিষয়ক সদস্যের পদ। এরপর ১৯১৫ তে কংগ্রেসের সভাপতি হওয়া এবং সে বছরই নাইটহুড পাওয়া, ১৯১৭ তে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেক্রেটারি অফ স্টেট লর্ড মন্টাগিউয়ের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংক্রান্ত Imperial War Cabinet এর সদস্য হওয়া, ১৯১৮ তে প্রথম ভারতীয় হিসেবে সম্রাটের সভাসদ হওয়া এবং শেষমেশ ১৯১৯ এ Under Secretary of India হয়ে Baron খেতাব লাভ করা। বীরভূমের রায়পুর জমিদার বাড়ির ছেলে হলেন Lord S.P. Sinha, 1st Baron of Raipur! ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হাউস অফ লর্ডসের সদস্য হয়ে যাওয়ার পরে ১৯১৯ এর Government of India Act পাস করানোয় নিলেন অগ্রণী ভূমিকা। এই ১৯১৯ সালেই সদ্য সমাপ্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা ও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের বিপুল কর্মকাণ্ড আয়োজিত হয় ফ্রান্সের ভারসেই শহরে। সেখানেও লর্ড সিনহা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেন। ভার্সেইয়ের শান্তিচুক্তিতে রয়েছে এই বাঙালির স্বাক্ষর। ১৯২০ সালে আন্ডার সেক্রেটারির পদে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে এলে তাঁকে ১৯২১ সালে বিহার আর উড়িষ্যার গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। একটা সময় সমগ্র উপমহাদেশের গভর্নর জেনারেল হিসেবেও তাঁকে ভাবা হয়েছিল। বলা বাহুল্য এহেন লর্ড সিনহাকে স্বদেশী আন্দোলনের তরুণ বিপ্লবীরা, এমনকি কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী সদস্যরাও ভালো চোখে দেখতো না। তিক্ততা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছায় যে ৬ ই এপ্রিল ১৯২১ সালে লর্ড সিনহা পুরী দর্শনে এলে কংগ্রেস সেখানে বন্ধ পালন করে। বন্ধের ঠেলায় লর্ড ও লেডিকে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বহুক্ষণ। এরপর ধীরে ধীরে সত্যেন্দ্র প্রসন্নর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। ১৯২১ এর ডিসেম্বরে উনি গভর্নরের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন। জীবনের শেষ বড় কীর্তি স্থাপন করেন ১৯২৬ এ ব্রিটিশ Judicial Committee of the Privy Council এর প্রথম ভারতীয় সদস্য হয়ে। ৩ রা মার্চ ১৯২৮ এ বহরমপুরে ছেলের বাড়িতে তাঁর জীবনাবসন হয়। মৃত্যুকালে তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ আজকের মূল্যে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ছিল। তাঁর পরে বাকি বংশধরেরা আর সেভাবে লাভ করেননি। তাদের গল্প পরে হবে একদিন। সে এক কেচ্ছা আর খুনের কাহিনীতে ভরা গল্প।
ভেঙে পড়া বাড়িটা এখন ভূতের বাড়ি হিসেবে রুপোলী পর্দায় বিখ্যাত। অথচ ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় এই অট্টালিকাটি এক কালে ৬০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত ৩ মঞ্জিলের ১২০ টি ঘর বিশিষ্ট প্রাসাদ ছিল। সম্ভবত ৬০ এর দশক অবধি এখানে মানুষের বসবাস ছিল। ৭০ এর দশকে এসে সম্পূর্নভাবে পরিত্যক্ত হয়ে যায় রায়পুর রাজবাড়ি। আর আজ, এই ২০২২-এ এই বিরাট ভগ্নস্তূপের বুকে দাঁড়িয়ে বার বার মনে হয় কতো ঘটনার মূক সাক্ষী এই নোনা ধরা দেওয়াল গুলো। দুজনে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে মশার কামড় খেতে খেতে আচমকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম দোতলায় উঠবো। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। অন্ধকার চাপা গলির মধ্য দিয়ে দুজনের শরীর গলিয়ে ঝুরঝুরে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় এসে আবিষ্কার করলাম এ বাড়ির ভেতরে আর বেশী ঘোরাফেরা করা যাবেনা। ২৫০ বছরের (রায়পুর যুব সংঘ ক্লাবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী) ইতিহাসের বোঝা বয়ে বেড়ানো সহজ নয়। টাকার অভাবে কে বা কারা ছাতের কাঠের বিম গুলো খুলে বেচে দিয়েছে জানা নেই। কিন্তু ওই বিম গুলো যেখানে নেই সেখানে ছাদ ভেঙে পড়েছে। পোড়ো বাড়িতে এখন সুর্য্য ইচ্ছে মতো খেলা করে। খেলা করে বর্ষাও। উঠোনে বেড়ে ওঠা তেঁতুল আর পেয়ারা গাছ গ্রামের ছেলেদের দুষ্টুমি আর পেটপুজো করার ভালো জায়গা। বাড়ির দেওয়ালে এখানে ওখানে প্রেম নিবেদনের আকুল প্রয়াস চোখে পড়ে। এই সমস্ত কিছু পার করেও নিঃশব্দ আলো আঁধারিতে এই বিপুল অট্টালিকা তার গরিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফোনের ক্যামেরায় তাকে যেন সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরতে পারলাম না।
ভেঙে পড়া বাড়িটাকে তার ধ্যানস্ত অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে দুজনে দুর্গাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আবার পরে দেখা হবে। আবার পরে কখনো ইতিহাস ঘেঁটে আরও কিছু গল্প তুলে আনা যাবে জনসমক্ষে। ভালো থেকো রায়পুর রাজবাড়ি।
প্রতিবেদন- হীরক দাশগুপ্ত
দারুণ দারুণ 👌👌👌
ReplyDelete