Header Ads

রঘু ডাকাতের দুঃসাহসিক কার্যকলাপ ঘুম কেড়ে নিত ব্রিটিশদের


দেড়শ-দুশো বছর আগের কথা। সে যুগে বাংলার বেশিরভাগ এলাকা ছিল গভীর বন-জঙ্গলে ঘেরা। বন্য পশুর ভয় যেমন ছিল, তেমন ছিল ডাকাতের ভয়। যে সে ডাকাত নয়, বাংলা জুড়ে দস্তুরমতো নামকরা ডাকাতরা ছিলেন সে আমলে। এইসব ডাকাতের ভয়ে শুধু যে সাধারণ প্রজারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত তাই নয়, ব্রিটিশ সরকার অবধি রীতিমতো অস্থির থাকতেন ডাকাতির উপদ্রবে। সেই সব ডাকাতির গা-ছমছমে গল্প আমরা ছেলেবেলায় দিদা-ঠাকুমার মুখে এক-আধ বার তো অনেকেই শুনেছি। আবার বাংলা সাহিত্যে এ বিষয়ে দুটি বিখ্যাত বইও লেখা হয়েছে। দুইটি বইয়ের নামই 'বাংলার ডাকাত'। একটির লেখক খগেন্দ্রনাথ মিত্র, অপরটির লেখক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। যাইহোক, বাংলার বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত?) এইসব ডাকাতরা যে প্রায় কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। আর এইসব কিংবদন্তি হয়ে ওঠা ডাকাতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্মান পেয়েছেন বোধকরি 'রঘু ডাকাত'। তাঁকে নিয়ে বাংলার জনমানসে আজও যে সংখ্যক 'মিথ' প্রচলিত আছে, তা রীতিমতোন নজরকাড়া।


রঘু ডাকাত সম্পর্কে জনমানসে এতো গল্প ছড়িয়ে আছে যে তার ভিড়ে আসল মানুষটিকে চিনে বের করাই বেশ কঠিন। অনেকে আবার এরকমও সন্দেহ করেন, রঘু ডাকাত চরিত্রটি পুরোপুরিই কাল্পনিক। তবে, রঘু ডাকাতের সম্পর্কে মোটামুটি যে পরিমাণ কিংবদন্তি আছে, তাতে মানুষটির অস্তিত্ব একেবারেই না থাকলে ঘটনার পরম্পরাতে কোথাও একটা গোলমাল ঠেকত। সেরকম কিছু গোলমাল যখন ঠেকে না, তখন মানুষটির অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান না হওয়াই ভালো। এই প্রবন্ধে রঘু ডাকাতের সম্পর্কে যে মিথগুলি পাওয়া যায় সেগুলো জড়ো করে তাঁর জীবন ও চরিত্রের খানিকটা অংশে একটু আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। মিথের মধ্যে অতিকথন থাকতে পারে। আবার এও হতে পারে, আজ গল্পে যতখানি পাওয়া যায় আসল মানুষটির জীবন তাঁর থেকেও বেশি রোমহর্ষক ছিল। শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার অর্থার কোন্যান ডায়াল একবার বলেছিলেন, গল্পের চেয়ে সত্য ঘটনা নাকি অনেক বেশি বিস্ময়কর হতে পারে। এ ক্ষেত্রে গল্পগুলির সত্যাসত্য বিচারের ভার পাঠকের হাতেই ছাড়লাম। 

খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত-র লেখা ছাড়াও অন্যান্য সূত্র থেকেও বেশকিছু তথ্য মেলে। মানুষটির আসল নাম রঘু ঘোষ ছিল। এলাকায় পরিচিত ছিলেন 'রঘু বাবু' নামেও। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে তখন অনেক গরিব কৃষককেই সর্বহারা হতে হতো। অনেকের প্রাণ যেত। রঘু ঘোষের ‘রঘু ডাকাত’ হয়ে ওঠার পেছনেও নাকি এরকমই এক গল্প।

নীলকরদের জুলুমের স্বীকার হয়ে পাইক-পেয়াদাদের হাতে নিগৃহীত হয়ে মারা যান রঘুর বাবা। রঘু'র তখন কিশোর বয়স। সেই বয়সেই ছিলেন লাঠি খেলায় ওস্তাদ। বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে কিশোর রঘুর দুই চোখে। শখের লাঠি খেলা তখন হয়ে ওঠে প্রতিবাদের অস্ত্র। আক্রোশে থানায় আগুন লাগানো, নীলকুঠিতে লুঠপাঠ চালানো শুরু করেন রঘু। তারপর আশেপাশের সমবয়সীদের দলে টেনে তৈরি হয় বৃহত্তর বাহিনী।

নীলকরদের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভের আগুন অনেকের মধ্যেই ছিল। রঘু সেটাকেই কাজে লাগালেন। রঘুকে নেতা হিসেবে পেয়ে নিপীড়িত মানুষগুলো সহজেই ঝাঁপিয়ে পড়ল এই আগুনের খেলায়। সেই ডাকাতের দলে ছিল রঘু'র ভাই বিধুভূষণ ঘোষ বা বুধো ঘোষও। রঘু ডাকাতের দল নীলকরদের লুঠপাঠ করে পাওয়া সম্পদ গরিব মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিত। নীলকর সাহেবদের হত্যা করে তাদের দেহ গাছে ঝুলিয়ে দিত। রঘু ডাকাত অচিরেই হয়ে উঠলেন নীলকর সাহেবদের ত্রাস এবং গরিব মানুষের 'রবিনহুড'। তবে, শুধুমাত্র নীলকর সাহেবরাই নয়। পরবর্তীকালে রঘু ডাকাতের শিকার হতে হতো জমিদার, বড়লোক, সুদখোর মহাজন - এদেরকেও। কিন্তু, যতো দিন গেছে গরিব মানুষের কাছে ভগবানের দূত হয়ে উঠেছেন রঘু ডাকাত।

সেকালের ডাকাতদের বেশ একটা নায়কোচিত ব্যাপার ছিল। অভিজাত গৃহকর্তার বাড়িতে আগাম চিঠি পাঠিয়ে, নরবলি দিয়ে কালীপুজো করে, মাথায় লাল ফেট্টি বেঁধে, কপালে রক্তবর্ণের তিলক এঁকে, রণ পা চড়ে সদলবলে ডাকাতি করতে আসত তারা। রঘু ডাকাতের মধ্যেও এ জাতীয় 'হিরোইজম' পরিপূর্ণ মাত্রায় ছিল। তাঁর দলের হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষই ছিল কালীর উপাসক। কালীর পুজো সেরেই ডাকাতি করতে বেরনো হতো। বর্তমান কলকাতার আশেপাশে তো বটেই বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, হুগলী এরকম অনেক জেলাতেই রঘু ডাকাত প্রতিষ্ঠিত বলে অনেক কালীমন্দির প্রসিদ্ধ। সে থেকে ধারণা হয়, রঘু ডাকাত বিভিন্ন সময়ে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বেশকিছু কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কাশীপুরের খগেন চ্যাটার্জি রোডের রঘু ডাকাতের কালী মন্দির (চিত্তেশ্বরী সর্ব্বমঙ্গলা কালী) তো সবার পরিচিত। বাসুদেবপুরের কালীমন্দিরও তাঁরই প্রতিষ্ঠা করা। বাঁশবেড়িয়ার ত্রিবেণীর কাছেই যে ডাকাতকালী, সেটিও রঘু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

রঘু ডাকাত কোথায় থাকতেন তা ঠিক করে কেউ জানত না। ফলে, তাঁকে ধরাও ছিল শক্ত। তবে, নৈহাটি থানা, বারাসতের কদমগাছি থানা থেকে হুগলী এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিস্তীর্ণ এলাকা তাঁর ডাকাতির মুক্তাঞ্চল ছিল। রণ পা চড়ে বিশ-ত্রিশ মাইল পথ অতিক্রম করে ডাকাতি সেরে সহজেই ফিরে আসত রঘু'র দল। সপ্তগ্রাম বন্দরে কোনও জাহাজ এলে তা রঘু ডাকাতের দলের খপ্পরে পড়ত। বাঁশবেড়িয়া অঞ্চলের ত্রাস ছিল রঘু'র ডাকাতদল। ব্রিটিশ পুলিশ তাড়া করলে তারা গা ঢাকা দিত ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে। 

নৈহাটি থানার দুর্গাচরণ চক্রবর্তী এবং কদমগাছি থানার শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামে দুই দারোগাকে কম জব্দ করেননি রঘু। দুর্গাচরণ চক্রবর্তী'র নাকাল হবার গল্পটি বেশ প্রচলিত। ঘটনাটি বেশ মজারও, তাই এখানে গল্পটি বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। রঘুকে ধরার জন্য নানারকম ফন্দি আঁটেন দুর্গাচরণ, কিন্তু, সফল হন না। মুখে বলেন, একবার মুখোমুখি দেখা হলে ব্যাটাকে সায়েস্তা করে ছাড়বেন। একদিন থানায় বসেই রঘু ডাকাতের চিঠি পেলেন দুর্গাচরণ: 

আপনার সঙ্গে আমার শীঘ্রই দেখা হবে। প্রস্তুত থাকিবেন।

ইতি-
সেবক রঘু 

সুখসাগরের জমিদারের সাথে দারোগাবাবুর বেশ বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। সেদিন জমিদার মশাইয়ের নাতির জন্মদিন। দারোগাবাবু নিমন্ত্রিত হয়েও কোনও কারণে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। দারোগাবাবু কাজকর্ম সেরে থানায় বসে একটু আয়েশ করছেন, এমন সময় এক জেলে দুইটি মাছ নিয়ে উপস্থিত। মাছ দুটি দারোগাবাবুর সামনে নামিয়ে কাপড়ের খুঁট থেকে একটি চিঠি বের করল জেলেটি। চিঠির মর্ম এই : নাতির অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেন নি বলে, জমিদার মশাই পুকুরে ধরা দুটি প্রমাণ আকারের মাছ এই বিশ্বস্ত লোকটির হাতে দিয়ে পাঠিয়েছেন। চিঠি পড়ে এবং মাছ পেয়ে দারোগাবাবু যে কেবল খুশি হলেন তাই নয়, জেলেটিকে বকসিশ অবধি দিলেন। এই ঘটনার দিন কয়েক পরেই দারোগা দুর্গাচরণের কাছে একটি চিঠি এসে উপস্থিত: 

আমি কথা দিয়েছিলাম আপনার সাথে সশরীরে একবার দেখা করে আসব। আমি কিন্তু কথা রেখেছি। ও হ্যাঁ! মাছ কেমন খেলেন?
ইতি-
আপনার সেবক রঘু 

ব্যাপার বুঝে দারোগাবাবু'র তো চক্ষুস্থির। যাকে ধরার জন্য রাতদিন এতো পরিকল্পনা, এতো পরিশ্রম করছেন, সে নিজে হাতের নাগালের মধ্যে এসেও ফসকে যাবে- এ যে মেনে নেওয়া বড় দুষ্কর। তবে, একবার নয়। আরও একবার দারোগা দুর্গাচরণের হাতের নাগালের মধ্যে এসেছিলেন রঘু। নৈহাটির কাছে ভাগিরথীর তীরে বিনোদবাবু নামে এক বড়লোক জমিদারের বিলাসবহুল একটি বাগানবাড়ি ছিল। একদিন বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে আড্ডা চলাকালীন রঘু ডাকাতের প্রসঙ্গ উঠলে অহংকারে বিনোদবাবু বলেছিলেন, যতো বড় দুঃসাহসী লোকই হোক না কেন, রঘু ডাকাতের সাধ্য নেই এই বাগানবাড়িতে আসার। কোনও ভাবে রঘুর কানে এই কথাগুলো পৌঁছায়। ব্যাস! আর যায় কোথায়? দিন কয়েকের মধ্যেই বিনোদবাবুর কাছে রঘুর চিঠি এসে হাজির:

"শীঘ্রই আপনার বাগানবাড়িতে দেখা হবে"। 

বিনোদবাবু ভালোই বুঝলেন এই চিঠির অর্থ কি। নৈহাটি থানার দারোগা বাবু দুর্গাচরণ চক্রবর্তী'র কাছে খবর গেল। পুলিশ বাহিনী নিয়ে দারোগাবাবু নিজে হাজির হলেন বাগানবাড়িতে। রঘু ডাকাতকে ধরার এ সুযোগ হাতছাড়া করতে তিনি রাজি নন। দিন কয়েকের মধ্যেই বিনোদবাবুর সাথে দেখা করার জন্য দামী গাড়ি চড়ে, দামী পোশাক পরে শ্যামবর্ণ, দীর্ঘকায় এক বাবু গোছের লোক এসে উপস্থিত।

চাকর-দারোয়ান খাতির করে বাবুটিকে বিনোদবাবুর কাছে নিয়ে গেল। বিনোদবাবু তাঁর জমিদারিতে ত্রিবেণীর কাছে একটি ছোট তালুক পত্তনি দেবার কথা ভাবছিলেন। আগত বাবুটি নিজের নাম জানালেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই তালুকটি পত্তনি নেবার ব্যাপারেই তাঁর উৎসাহ। সদর্থক কথাবার্তা হল। অগ্রীম একশ টাকা দিয়ে কাগজে লেখাপড়া হল। এদিকে রঘু ডাকাত আর এলো না দেখে পুলিশ বাহিনী হতোদ্যম হয়ে ফিরে গেল। দারোগাবাবুও ফিরে গেলেন। বিনোদবাবুও নিজের বন্ধুমহলে সগর্বে বলে বেড়াতে লাগলেন, কই? রঘু ডাকাতের কলিজায় তো দম হল না আমার বাগানবাড়িতে হানা দেওয়ার! 

কিছুদিন পরেই এক রাত্রির অন্ধকারে বাগানবাড়ির পাশে নদীতে এসে দাঁড়াল ছিপনৌকা। তা থেকে বাগানের বড় বড় গাছ বেয়ে চুপি চুপি উঠে এলো একদল লোক। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল একজন শ্যামবর্ণ, দীর্ঘকায় লোক। প্রহরীরা ঘুমের ঘোরে কেউ টের অবধি পেল না। তারপর প্রহরীদেরই অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদেরকে ভয় দেখিয়ে লুঠপাঠ চলল। সেই শ্যামবর্ণ, দীর্ঘকায় চেহারার নেতাটি স্বয়ং বিনোদবাবুকে ঘুমন্ত অবস্থায় হাত-পা-মুখ বেঁধে তাঁর সামনে একটি চিঠি রেখে গেলেন। তাতে দিন কয়েক আগে একটি তালুক পত্তনি দেবার জন্য যেমন ধন্যবাদ দেওয়া, তেমনি সদর্পে জানান দেওয়াও ছিল যে কথা রাখতে রঘু ডাকাত এসেছিল।

অবশেষে বিনোদবাবু অবধি সহাস্যে মানলেন, রঘু ডাকাত ডাকাবুকোই বটে। তবে কিনা জমিদারির খানিক অংশ পত্তনী নিয়ে এখন তিনি বিনোদবাবুর প্রজা হয়েছেন। যেদিন রঘু পত্তনী নিতে বাবু সেজে এসেছিলেন সেদিন সশরীরে উপস্থিত ছিলেন দারোগা দুর্গাচরণ বাবুও। বলা বাহুল্য, এ বারেও তিনি দিন কয়েক পরে রঘু'র একটি চিঠি পান। তাতে লেখা ছিল- "দু’বার আপনার সাথে দেখা করে এলাম। ধরতে পারলেন না তো!"

এই দুঃসাহসী চরিত্রের বাইরেও রঘু ডাকাতের আর একটি দিক ছিল।গরিব-দুখীদের কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারতেন না। নিজের যতটুকু ক্ষমতা, তাই দিয়ে সেই কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করতেন তিনি। একবার চূর্ণী নদীর তীরে কোনও এক গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের মেয়ের বিয়ে। বরযাত্রী নদীতীরে নৌকা বেঁধে অপেক্ষা করছে। পাত্র কুলীন। সেকালে কুলীন ব্রাহ্মণ পাত্রের বড়ই চাহিদা ছিল। তাই কুলীন পাত্রস্থ করতে মেয়ের বাবাকেও দিতে হতো মোটা অঙ্কের পণ। এই পণ নিয়ে গন্ডগোল হওয়াতে বরকর্তা বেঁকে বসেছেন, পণের হিসেব আগে বুঝে না নিয়ে তিনি বরকে নিয়ে যাবেন না। খবর পেয়ে রঘু ডাকাত চূর্ণী নদীর তীরে সশরীরে হাজির। রঘু হেঁকে বরকর্তাকে বলল, ঠাকুর! তুমি যেই হও, ভালোয় ভালোয় বিয়েবাড়ি চল। নয়তো, নৌকাশুদ্ধ তোমাদের তুলে নিয়ে যাব। লোকটির স্পর্ধা দেখে অবাক বরকর্তা জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমাদের আদেশ করার কে হে তুমি? উত্তরে 'রঘু ডাকাতে'র নাম শুনে বরকর্তা কাঁপতে কাঁপতে বর ও বরযাত্রী বিয়েবাড়িতে হাজির। এও শোনা যায় পণের সমস্ত টাকা নাকি স্বয়ং রঘু ডাকাত মিটিয়ে দিয়েছিলেন। 

শোনা যায় ইংরেজ সরকার একসময় রঘুকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে তাঁকে ধরিয়ে দেবার জন্য পুরষ্কার ঘোষণা করে। রঘু ডাকাতকে ধরার জন্য নানারকম ছক কষা হয়। পুলিশ বাহিনী এদিকে ওদিকে পাগলের মতো তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করে রঘু আর দলবলকে। বাধ্য হয়ে রঘু প্রথমে আশ্রয় নেন পান্ডুয়াতে। পরে এক রাত্রে দেবীপুরের পাশে এক ঘন জঙ্গলকে নিরাপদ মনে করে, রাতারাতিই সেই খানে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন রঘু ডাকাত। একটি পরিপূর্ণ গ্রামে কয়েকঘর ব্রাহ্মণ না থাকলে গ্রামের মর্যাদা কমে যাবে। এই ভেবে বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, ঘোষাল ও ভট্টাচার্য্য - এই পাঁচ ঘর ব্রাহ্মণকেও সসম্মানে সেখানে এনে রাখলেন রঘু ডাকাত। নিশাকালে বা রাত্রে এই গ্রামের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলে গ্রামের নাম হয়- নিশিনগর। বর্তমানে জনমুখে গ্রামটির নাম বদলে হয়েছে নিশরাগড়। 

রঘু ডাকাত জন্মসূত্রে বৈষ্ণব হয়েও নিষ্ঠা সহকারে কালী উপাসনা করতেন। শোনা যায়, তিনি বৈষ্ণব ছিলেন বলেই নাকি রক্তবস্ত্র না পরে পট্টবস্ত্র পরে কালীর পুজোতে বসতেন। মাতৃ উপাসক ছিলেন বলেই কি না জানি না, রঘু ডাকাত কোনও দিন কোনও নারীর ওপর অত্যাচার করেন নি। ডাকাতির সময় পরিবারের মহিলাদের কাছে হাতজোড় করে বলতেন, মা! দয়া করে তোমার গায়ের গয়নাগুলি আমাদের দিয়ে দাও। 

সাধক কবি রামপ্রসাদ ও রঘু ডাকাতকে নিয়ে একটি বহুল প্রচলিত কাহিনী আছে। বাসুদেবপুর ডাকাত কালী মন্দিরে নরবলি দিয়ে ল্যাটা মাছের ভোগ নিবেদন করে কালীপুজো করতেন রঘু ডাকাত। তারপর মহাপ্রসাদ খেয়ে ডাকাতিতে বের হতো তাঁর দল। এই ভয়ে ওই এলাকার আশেপাশে কোনও লোক দুপুরের পর থেকে পথ পার হতে সাহস পেত না। একবার সাধক কবি রামপ্রসাদ এই পথেই ত্রিবেণী ফেরিঘাট থেকে ফিরছিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি পড়লেন রঘু ডাকাতের পাল্লায়। রঘু ডাকাত তাঁকেই বলি দিয়ে সেদিনের পুজো সমাপন করতে মনস্থ করলেন। প্রাণ বিয়োগ আসন্ন দেখে মাতৃভক্ত রামপ্রসাদ তাঁর শেষ ইচ্ছের কথা জানালেন রঘু'কে। বললেন, মৃত্যুর আগে মা-কে একটি গান শোনাতে চাই। রঘু আপত্তি করলেন না। রামপ্রসাদ গান ধরলেন- "তিলেক দাঁড়া শমন ওরে বদন ভরে মা-কে ডাকি"। লোকমুখে শোনা যায়, এর পর নাকি হাঁড়িকাঠে রঘুডাকাত রামপ্রসাদের বদলে স্বয়ং মা কালী-কে দেখতে পেয়েছিলেন। এ দৃশ্য দেখে রঘু নিজের ভুল বুঝতে পেরে মায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত রামপ্রসাদকে বলি দেওয়া থেকে বিরত হন। বহু সেবা-যত্ন করে রামপ্রসাদকে পরদিন বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেন। 

কেউ কেউ বলেন, মাতৃ আদেশে পরবর্তী কালে রঘু ডাকাতও নাকি ডাকাতির পথ ছেড়ে মাতৃ উপাসনায় জীবন অতিবাহিত করতেন। যদিও রঘু ডাকাতের শেষ জীবন সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না, তবুও গ্রাম বাংলার নিপীড়িত মানুষদের কাছে তিনি ছিলেন দেবদূত। রঘু ডাকাতকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে এদেরও যথেষ্ট ভূমিকা ছিল বলে মনে হয়। তাই বোধহয় হাজার চেষ্টা করেও সরকার কোনদিন রঘু ডাকাতের নাগাল পান নি। অথচ, বিপদে-আপদে চাইলেই রঘু ডাকাতের সাহায্য পেয়েছে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত মানুষগুলো। 

প্রতিবেদন- অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায়


No comments