Header Ads

নীলকরদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন ভারতীয় সাংবাদিকতার জনক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়


বিমল হৃদয়ে দেহ প্রাণ দিয়ে স্বদেশের এমন সেবা খুব কম ভারতীয়ই করেছেন, তাঁর কলমের জোর ইংরেজদের  চাবুকের তুলনায় কম শক্তিশালী ছিল না, তিনি ভারতীয় সাংবাদিকতার জনক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়৷ সংবাদমাধ্যম নিশ্চিতভাবে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ৷ বলা হয় সংবাদ মাধ্যম সবল না হলে আখেরে দুর্বল হয় গণতন্ত্র। তবে তখন অবশ্য আমাদের দেশে গণতন্ত্র বলে কোনও বস্তু ছিল না, ইংরেজদের শাসন আর সঙ্গে নীলকরদের শোষণ-এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন এক নির্ভীক, দৃঢ়চেতা বঙ্গসন্তান, 'হিন্দু পেট্রিয়ট'-এর আপসহীন সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।


'ভারতীয় সাংবাদিকতার জনক' তিনি, সিপাহি বিদ্রোহকে 'দি গ্রেট ইন্ডিয়ান রিভোল্ট' বলার দুঃসাহসিকতা সে সময়ে যিনি প্রথম দেখিয়েছিলেন তাঁর নাম যে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়৷ সারাদিন কাজ করতেন, সাংঘাতিক সেই পরিশ্রম, হরিশচন্দ্রের মা জননী সেসব দেখে সহ্য না করতে না পেরে প্রতিবাদ করে বলতেন 'ওরে মানুষের শরীর এত শ্রম সবে না, ওরে মারা পড়বি,ওরে কলম রাখ'৷ 'হিন্দু পেট্রিয়ট'-এর পাতায় হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ওজস্বিনী ভাষাতে প্রজাদের যে দুঃখের কথা স্মরণ করে  চিত্র অঙ্কিত করেছিলেন, সেসব চিত্রের অধিকাংশ 'নীলদর্পণ'-এর স্রষ্টা দীনবন্ধু মিত্র নিজের চোখে দেখেছেন। চাষীদের ধর্মঘটে নীলকরদের অত্যাচার আরও বেড়ে যায়, যশোর, নদীয়া সহ অনেক জেলার জমিদার ও প্রজাদের সাথে নীলকরদের সংঘাত বাড়তে লাগল৷ জেলার ম্যাজিষ্ট্রেট নীলকরদের স্বজাতীয় সুতরাং প্রজারা সুবিচার পেতেন না৷ তাতেও চাষীরা দমলেন না, অনেকে ধনে-প্রাণে সারা হয়ে গেলেও, নিরস্ত হতেন না৷ 

অত্যাচারিত প্রজাদের পক্ষে কলম ধরলেন 'হিন্দু পেট্রিয়টের' সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়৷ নীল বিদ্রোহের একের পর এক বিবরণ প্রকাশ করতে থাকেন হরিশ। তাঁর মনে হল বাংলাদেশের ইতিহাসে এ এক অসাধারণ ঘটনা। এই বিরাট বিপ্লবের সময় তাদের হয়ে না লিখে যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকেন তাহলে সেটা বোধহয় হবে জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাপ! বার বার নীল কমিশন বসানোর দাবি জানান তাঁর সাহসী লেখনীতে ১৮৬০ সালে গঠিত হল 'ইণ্ডিগো কমিশন', জেলায়-জেলায় ঘুরে কমিশনের সদস্যরা নীলের অত্যাচার সম্পর্কিত তথ্য জোগাড় করতে লাগলেন৷ হরিশ মুখোপাধ্যায় কমিশনের সামনে নীলকরদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেন৷ চারিদিকে ছিঃ ছিঃ রব উঠল, নীলকর সাহেবদের হয়ে আর্কিবিল্ড হিলস নামের এক সাহেব সুপ্রিম কোর্টে 'হিন্দু পেট্রিয়টের' নামে ফৌজদারি মামলা করলেন, ভবানীপুর সুপ্রিম কোর্টের এলাকা নয় বলে সে মামলা উঠে গেল৷ 

বন্ধু গিরিশচন্দ্র ঘোষের থেকে জেনেছিলেন নতুন এক সংবাদপত্র আসতে চলেছে, যার নাম, 'হিন্দু পেট্রিয়ট'। এবার ব্রিটিশদের কার্যত মুখপাত্র 'ইংলিশম্যান'কে মুখের মত জবাব দেওয়া যাবে৷ 'হিন্দু পেট্রিয়ট'-এর পাতায় লেখা শুরু করলেন, সে যেন শব্দ, বাক্য নয় তাঁর কলম যেন চাবুক৷ তিন মাসের মধ্যেই পত্রিকার সম্পাদক হলেন৷ নিদারুণ ঋণের ভার সহ্য করেও 'হিন্দু পেট্রিয়ট'-কে বাঁচাতে তার স্বত্ব কিনে নিয়েছিলেন৷

স্মরণে রাখতে হবে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় শুধুমাত্র পত্রিকা সম্পাদনা করতেন এমন নয় নীলকরদের অত্যাচারে পীড়িত মানুষের সমাগমে সর্বদা তাঁর ভবন লোকারণ্য থাকত৷ কারও দরখাস্ত লিখে দিচ্ছেন, কাউকে উকিলের সুপারিশের চিঠি, কারও মোকদ্দমার হাল শুনছেন, সামান্য সময় বিশ্রাম পেতেন না, পত্রিকার সম্পাদনার জন্য অনেকটা পড়াশোনা করে প্রবন্ধ লেখার পর সাধারণ মানুষের জন্য নিজের সবটাই ব্যয় করতেন, শোনা যায় পত্রিকা দপ্তর থেকে ফিরে রাত্রি দ্বিপ্রহর পর্যন্ত পোশাক বদল করার সুযোগ পেতেন না, অফিসে কলম ছেড়ে এসে আবার বাড়িতে লিখতে বসতেন৷

তাঁর এই কঠিন পরিশ্রমে মা জননী প্রতিবাদ করে বলতেন 'ওরে মানুষের শরীর এত শ্রম সবে না, ওরে মারা পড়বি, ওরে কলম রাখ'৷ মায়ের কথায় সন্তান বলতেন মা তোমার সব কথা শুনব কিন্তু এই গরীব প্রজাদের জন্য যা করছি তাতে বাধা দিও না ওরা ধনে-প্রাণে সারা হল, এ কাজ না করে আমি ঘুমাতে পারব না৷ গুরুতর শ্রমে দেহ-মন যখন ক্লান্ত হয়ে যেত, সুরা পান করে অবসন্ন মনকে সতেজ করার চেষ্টা সেই সময় তিনি করেছেন৷ 'হিন্দু পেট্রিয়ট'-এর সম্পাদক কে ধনে প্রাণে সারা করার জন্য নীলকর ইংরেজরা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়েছে, কিন্তু তাঁর কলম থামেনি৷ ভারতে নীলচাষ বন্ধের আন্দোলনে মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন সাংবাদিক হরিশচন্দ্র একথা বললে অনেক কথা কম বলা হয়৷ পরাধীন ভারতে জাতীয় চেতনার উদ্বোধন যদি করে থাকে বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ' গ্রন্থ, তবে পুরোধা হিসেবে যেমন বলতে হবে দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ' নাটক, তেমন হরিশচন্দ্রের 'হিন্দু পেট্রিয়ট'৷ 

অতিরিক্ত পরিশ্রমে হরিশের শরীরে মারণ রোগ যক্ষ্মা বাসা বাঁধায় সব অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিল, শেষের দিনগুলো তাঁর কেটেছিল ঔপনিবেশিক শাসক আর যক্ষ্মা রোগের সঙ্গে লড়াই করে। এক দিন বত্রিশ বছরের দীনবন্ধু মিত্র 'নীলদর্পণ' নিয়ে দেখা করতে আসেন হরিশের সঙ্গে। আর এক দিন এসেছিলেন রেভারেন্ড জেমস লঙ, নীল আন্দোলনের আর এক পুরোধা। নীলদর্পণ'কে লিখেছেন জানা না গেলেও, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন, পাদরি লঙ সাহেব নিজের নামে প্রকাশ করলেন, নীলকরদের বিরুদ্ধে দেশে যে আন্দোলনের সুত্রপাত সেই ঢেউ পৌঁছে গিয়েছিল ইংল্যান্ডে, সেখানেও উঠেছিল প্রতিবাদ ৷ নীলকররা আসল গ্রন্থকার কে না পেয়ে 'ইংলিশম্যান' পত্রিকার সম্পাদক কে মুখপাত্র করে ১৮৬১ সালের ১৯শে জুলাই লঙ সাহেবের নামে আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছিল, এমন মোকাদ্দমা অতীতে হয় নি, লঙ সাহেব আত্মপক্ষ সমর্থনে বললেন তিনি অনেকদিন ধরে এদেশের দেশের সংবাদপত্রের ও গ্রন্থের বক্তব্য প্রশাসনের গোচরে আনছিলেন, 'নীলদর্পণের' অনুবাদ সেই কাজের অঙ্গস্বরূপ, কিন্তু তদানীত্নন ইংরেজ জজ স্যার মর্ডান্ট ওয়েলস সেসব কথায় কর্ণপাত করলেন না৷ বিচারে লঙ সাহেবের একমাস কারাবাস ও এক হাজার টাকা জরিমানা হল, কিন্তু নীলকরদের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের বিদ্বেষ তখন এত প্রবল মহাভারতের অনুবাদক সুপ্রসিদ্ধ কালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয় জরিমানার হাজার টাকা গুনে দিলেন, শোনা যায় আরও অনেক এদেশের মানুষ আদালতে জরিমানার টাকা দেওয়ার জন্য টাকা নিয়ে উপস্থিত ছিলেন৷ হরিশ মুখার্জী যখন জীবনের শেষ লগ্নে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে কালীপ্রসন্ন সিংহ বলেছিলেন লক্ষ লক্ষ গরীব নীলচাষী এ বার পিতৃহীন হয়ে যাবে৷

'নীলদর্পন' প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬০ সালে আর ১৮৬১ সালের জুন মাসে মাত্র ৩৭ বছরে ইহলোক হতে অন্তর্হিত হলেন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মাত্র ৩৭টি বসন্ত তিনি এই পৃথিবীতে বাঁচার সুযোগ পেয়েছেন কিন্তু সেই স্বল্প সময়ে বিমল হৃদয়ে দেহ প্রাণ দিয়ে স্বদেশের এমন সেবা খুব কম বঙ্গসন্তানই করেছেন৷ নিজে এলিট শ্রেণির এক জন হয়েও উনিশ শতকের বাংলায় নিজেকে খুঁজে নিয়েছিলেন শোষিত, নিপীড়িত, প্রান্তিক মানুষের মধ্যে। সাংবাদিক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের প্রতি দেশবাসীর অকৃত্রিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা থাকবে, যতদিন নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষকের আন্দোলন মানুষ মনে রাখবেন, যতদিন ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম বেঁচে থাকবে৷

প্রতিবেদন- অরুণাভ সেন 

তথ্যসূত্র- রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ : শিবনাথ শাস্ত্রী।


No comments