Header Ads

মধ্যযুগের কাব্য 'সত্যপীরের পাঁচালি'-র আদি প্রণেতা কবি কংক


মধ্যযুগে‌ লেখা পীরসাহিত্যের একখানা চমৎকার গ্রন্থ যেখানে সত্যপীরের মহিমা বর্ণিত হয়েছে বা বলা ভালো কীর্তিত হয়েছে সেই 'সত্যপীরের পাঁচালি'-র নাম আমরা অনেকেই শুনেছি। একাধিক মধ্যযুগীয় কবি বিভিন্ন শিরোনাম দিয়ে এই পাঁচালি রচনা করেছিলেন। পাঁচালির বিভিন্ন নামগুলি হল 'সত্যপীরের পাঁচালি', 'সত্যপীরের কথা' আবার 'সত্যনারায়ণের পাঁচালি' ইত্যাদি। যেসব কবিরা এই ধরনের পাঁচালি রচনা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কবি কংক, রামানন্দ, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, শেখ ফয়জুল্লাহ, ভারতচন্দ্র, শাহ্ গরীবুল্লাহ ইত্যাদি। আগে উল্লেখিত পাঁচালির বিভিন্ন নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে 'সত্যপীরের পাঁচালি' হিন্দু ধর্মের দেব-দেবী এবং ইসলাম ধর্মের সুফি সাধক-ফকির ও দরবেশদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার এক সুন্দর সমন্বয়। সত্যপীরের পাঁচালির আদি প্রণেতা হলেন কবি কংক। এঁর জীবনকাল ১৫ শ থেকে ১৬ শ শতক। তাই, মনে করা যে ইনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক ছিলেন এবং তাঁর ভক্ত ছিলেন। আর সে জন্যই, তাঁর লেখা সত্যপীরের পাঁচালিতে বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কবি কর্ণ নামক একজন কবির উড়িয়া হরফে বাংলা ভাষায় লিখিত 'সত্যপীরের পাঁচালি'-র একটি পুঁথি পাওয়া গিয়েছিল। অনেক গবেষকের মতে, এই কবি কর্ণ ও কবি কংক একই ব্যক্তি। যদিও সে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।


কবি কংক জন্মগ্রহণ করেন তৎকালীন অখণ্ড বাংলার নেত্রকোনা (যা বর্তমানে অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের অন্তর্গত) জেলার কেন্দুয়া উপজেলার বিপ্রগ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। দুঃখের বিষয় এই যে, তাঁর যখন ছয়মাস বয়স তখন তাঁর পিতা ও মাতা দুজনেই মারা যান। অনাথ এই শিশুটিকে মানুষ করেছিলেন এক চণ্ডাল দম্পতি যাঁদের নাম মুরারি ও কৌশল্যা। তাঁরাই এই শিশুটির নাম দিয়েছিলেন কংকধর বা কংক যা পরবর্তীকালে 'কবি কংক' নামে পরিচিতি পায়। ওই চণ্ডাল দম্পতির ঘরেই লালিত-পালিত হচ্ছিল শিশুটি। কিন্তু হায়! কয়েক বছর পর কংকের এই পালক দম্পতিও মারা যান। আবার অনাথ হলেন তিনি। এবার তাঁকে মানুষ করে গর্গ পণ্ডিত ও গায়ত্রীদেবী নামক এক ব্রাহ্মণ দম্পতি। তাঁদের গৃহে আশ্রয় নেন কংক। এই গৃহে থাকাকালীন তিনি গো-পালকের কাজ করতেন বলে জানা যায়। 

কংক যখন ছোট তখন থেকেই তাঁর মধ্যে কবিপ্রতিভা প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর কবিপ্রতিভা এমনই ছিল যে মুখে মুখে তিনি ওইটুকু বয়সেই শ্লোক রচনা করে ফেলতে পারতেন। আর অসাধারণ বাঁশি বাজাতে পারতেন। সে কি সুর! ওইটুকু মাত্র বয়সে এত প্রতিভার বিকাশ সত্যিই বিস্ময়কর। প্রতিভা কারুর চাপা থাকে না। কংকের আশ্রয়দাতা গর্গ পরিচিত হলেন তাঁর পালিত পুত্রের প্রতিভার সাথে। বিস্ময়ের সাথে এতটাই খুশি হলেন যে তিনি কংকের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেন।

গর্গের কন্যার নাম ছিল লীলা। একসাথে থাকা ও বেড়ে ওঠার ফলে কংক ও লীলা দুজনেরই মধ্যে তৈরি হয় অনুরাগ ও ভালোবাসা। এই সময়েই এক মুসলিম ফকিরের সঙ্গলাভ করেন কংক। আর এই ফকিরের সংস্পর্শের ফলে তিনি হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই ধর্ম পরিবর্তনের মতো আকস্মিক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পাশাপাশি ঘটে যায় বাংলা সাহিত্যের এক অভাবনীয় সৌভাগ্যজনক ঘটনা। ওই ফকিরের আদেশেই কংক রচনা করেন 'সত্যপীরের পাঁচালি' যা তাঁকে 'কবি কংক' নামে পরিচয় দেয় বাংলা সাহিত্যের জগতে।

তখনকার দিনে ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল প্রবল। কংক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে জেনে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় তাঁর ওপর বেজায় ক্ষেপে গেল। এমনকি কংকের আশ্রয়দাতা গর্গও তাঁর প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সমাজে তাঁকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র তৈরি হয়। এমন অবস্থায় সেখানে থাকাটা নিরাপদ নয় দেখে কংক সেই গৃহ ও স্থান পরিত্যাগ করে পলায়ন করেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে তিনি সত্যপীরের পাঁচালি কীর্তন করতে থাকেন। আর এভাবেই তাঁর সত্যপীরের পাঁচালি হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য রতন। গোটা বাংলায় বিশেষ করে ময়মনসিংহে এই পাঁচালির গ্রন্থটি বহুযুগ ধরে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। সত্যপীরের পাঁচালি ছাড়াও 'মলয়ার বারমাসী' নামে আরেকটি কাব্য কবি কংক রচনা করেছিলেন।

জানা যায় শেষ জীবনে কবি কংক উড়িষ্যার পুরীধামে গিয়েছিলেন। হতে পারে হয়তো তিনি তাঁর প্রভু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মতোই শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের শ্রীচরণে বিলীন হয়েছিলেন। আর বাংলার ঘরে ঘরে অমর হয়ে রইলেন 'সত্যপীরের পাঁচালি'-তে।

প্রতিবেদন- ইন্দ্রনীল মজুমদার


No comments