Header Ads

বাঁকুড়ার বিধবা কন্যা কালীমতীর সঙ্গে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিবাহ ছিল প্রথম বিধবা বিবাহ


'উনবিংশ শতাব্দী' বাংলা সাহিত্য তথা বাঙালির সমাজ ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় সমাজ থেকে সতীদাহ প্রথার অভিশাপ দূরীভূত হয়েছিল। হিন্দুদের সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত ছিল সতীদাহ প্রথা। যে প্রথা ছিল মধ্যযুগীয় বর্বরতার থেকেও ভয়ংকর। হিন্দু বিধবাদের জোরপূর্বক সতী হতে বাধ্য করা হতো। তাদের ধর্মীয় ও শাস্ত্রের অজুহাত দেখিয়ে সতী বানানো হতো। রক্ষণশীল সমাজের লোকেরা তাদের বিধবা নারী সতী হলে নাকি বংশমর্যাদা বৃদ্ধি পাবে কিংবা সতী হওয়া নাকি পূণ্যের কাজ; এই বলে বিধবা নারীদের নানাভাবে বিরক্ত করে সতী বানিয়ে দেওয়া হতো।


স্বামীর মৃত্যুর পর তার অসহায় স্ত্রীকে আফিং বা সেদ্ধ জাতীয় মাদকদ্রব্য সেবন করিয়ে মাতাল করে দেওয়া হতো। তারপর সেই অসহায় নারীকে হাত-পা বেঁধে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় ঠেলে দেওয়া হতো। তারপর দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের লেলিহান শিখার উত্তাপে কাঠফাটা যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে উচ্চস্বরে চিৎকার করে চিতাতে লুটিয়ে মৃত্যুবরণ করতেন অসহায় নারীরা। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের এমন ভয়ংকর হত্যালীলাকে লড়াই করে থামিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়। যা বন্ধ না হলে হিন্দু নারীদের সেকেলে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়তো।  

কলকাতার হিন্দু সমাজের একাংশ ১৮১৯ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসকে সতীদাহ প্রথা রদ করতে আবেদন পেশ করেছিলেন এবং অনেকেই এই প্রথার বিপক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন। ১৮২৯ সালের ৪ ঠা ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে সতীদাহ প্রথাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয়। অবশ্য এ আইনি কার্যক্রম গৃহীত হয় মূলত রাজা রামমোহন রায়ের সামাজিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই। 

সতীদাহ প্রথা রদ হওয়ার ফলে বিধবারা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও বিধবাদের কষ্ট তবুও কমলো না। বিধবা নারীদের জীবন বেশ কষ্টে অতিবাহিত হতো, এর একটাই কারণ সমাজের মানুষেরা তাদের খারাপ চোখে দেখতেন। বিধবার পরিবারের লোকেরা তাদের ওপর শারীরিক অত্যাচার চালাতেন।  এমন সময় কোনো কোনো নারীর মনে হতো সতী হয়ে চিতায় উঠলে হয়তো তিনি শান্তি পাবেন। সতীদাহ প্রথা রদ হলেও তার সুফল সঠিকভাবে পাচ্ছিলেন না বিধবারা। সমাজ ও সংসারের চোখে সসম্মানে যদি তাদের পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা করতো সরকার তাহলে এই আইন যথার্থই সুফলদায়ী হতো। 

বিদ্যাসাগর বিধবাদের এই অসহায় নিদারুন যন্ত্রণার শরিক হয়েছিলেন বলেই প্রথমে 'সর্বশুভকরী' পত্রিকায় 'বাল্য বিবাহের দোষ' প্রসঙ্গে লিখলেন - "পতি বিয়োগ দুঃখের সহ সকল দুঃসহ দুঃখের সমাগম হয় উপবাস দিবসে পিপাসা নিবন্ধে কিংবা সাংঘাতিক রোগানুবন্ধে যদি তাহার প্রাণাপচয় হইয়া যায় তথাপি নির্দ্দয় বিধি তাহার নিঃশেষ নিরস রসনাগ্রে গন্ডুষমাত্র বারি বা ঔষধ দানের ও অনুমতি দেন না।"

উনিশ শতকের মাঝামাঝি। বীরসিংহ গ্রামে বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গ্রামের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এমন সময়ে মা ভগবতী দেবী অকাল বিধবা পড়শি কিশোরীর দুঃখে আকুল হয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে বিধবাদের বাঁচার উপায় জানতে চাইলেন। একই প্রশ্ন রাখলেন ঠাকুরদাসও। বিদ্যাসাগর জানালেন, এমন বিধবার আবার বিয়ে শাস্ত্র সিদ্ধ। এ বিষয়ে তাঁর বই লেখার ইচ্ছে আছে। কিন্তু সমাজে বিরোধের আশঙ্কায় দ্বিধাগ্রস্ত। ঠাকুরদাস ও ভগবতী দেবী দু'জনেই এগিয়ে যেতে বললেন৷ তিনি বুঝেছিলেন ধর্মের, সমাজের শাস্ত্রের গোঁড়ামি শাস্ত্র দিয়েই ভাঙতে হবে। 

শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা থেকে জানা যায়, এই সময়ে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের পাঠাগারে দিবারাত্র নানান শাস্ত্র পাঠ আরম্ভ করলেন। মাঝে একবার কেবল বিরতি নিতেন খেতে যাওয়ার জন্য৷ সালটা ১৮৫৩, শীতকাল। রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, একদিন তাঁর সামনেই বিদ্যাসাগর 'পেয়েছি, পেয়েছি' বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। তিনি পেয়ে গিয়েছেন পরাশর সংহিতা দু'লাইনের একটা শ্লোক।

"নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ" অর্থাৎ স্বামী নিখোঁজ হলে বা তাঁর মৃত্যু হলে, নপুংসক আর পতিত হলে তাঁর স্ত্রী আবার বিয়ে করতে পারেন। এই যুক্তির নিরিখে বিধবাদের বিয়ের পক্ষে তিনি দুটি বই লিখলেন। ১৮৫৫ সালের হেমন্তে সেই দুটি বই তিনি প্রচার করতে থাকেন। 'বিধবা বিবাহ প্রচলন হওয়া উচিৎ কিনা' এই প্রস্তাবে সমগ্র ভারতজুড়ে আলোচনা চলতে থাকে। কেউ কেউ বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে পথে নেমেও প্রতিবাদ জানাতে থাকে। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ বিদ্যাসাগরকে কুৎসিত ভাষায় গালাগালিও দিতে থাকে। কিন্তু পুরাকালেই বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল। ধর্মশাস্ত্রের বিচার দিয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সেকালের তাবড় তাবড় ধর্মবেত্তার সঙ্গে সমালোচনার ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। যদিও সেই যুদ্ধে বিদ্যাসাগর জয়ী হন। 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অত্যন্ত বাস্তবমুখী ছিলেন। তিনি জানতেন বিধবা বিবাহের প্রচলন শাস্ত্র দিয়ে হবেনা যতক্ষণ না তা আইনি ভাবে কার্যকর হচ্ছে। বিধবা বিবাহের ফলে জাত সন্তানরা যাতে পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হতে পারে তার জন্য বিধবা বিবাহকে আইনানুগ করতে হবে। যে কারণে বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহকে শাস্ত্রীয় যুক্তিতে প্রমাণ করে ক্ষান্ত হলেন না। তিনি বিধবা বিবাহের সপক্ষে আইন পাশের ব্যাপারে ভারত সরকারের নিকট আবেদনপত্র  পাঠানোর জন্য গণস্বাক্ষর কর্মসূচী গ্রহণ করেন। ১৮৫৫ সালের ৪ ঠা অক্টোবর বিদ্যাসাগর ৯৮৬ জন লোকের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র ভারত সরকারের কাছে প্রেরণ করলেন। 

বিধবা বিবাহ আইনের পক্ষে যতগুলো স্বাক্ষর তার থেকেও বহুগুণ বেশি স্বাক্ষর পড়েছিল বিধবা বিবাহ আইনের বিপক্ষে। সেই সময়ের খবরের কাগজগুলি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব, কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত-সহ অনেক প্রভাবশালী মানুষ সরাসরি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। ব্যঙ্গ পদ্যও প্রকাশিত হলো 'সমাচার সুধাবর্ষণ' পত্রিকায়। "সাজো গো বিধবাগণ ফুটিয়াছে ফুল। তোমাদের সৌভাগ্য ঈশ্বর অনুকূল।" নামে, বেনামে বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করে বহু চিঠি প্রকাশিত হতে থাকল। 

১৮৫৬ সালে অবিভক্ত বর্ধমান থেকেও একটি আবেদন সরকারকে দেওয়া হয়। বর্ধমানের রাজা মহতাব চাঁদ বিদ্যাসাগরের সমর্থনে সই করলেন। প্যারীচরণ সরকার, রাজনারায়ণ বসু, প্যারীচাঁদ মিত্র, কিশোরীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ মহান ব্যক্তিরা বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবের সমর্থনে সরকারের কাছে আবেদন পাঠালেন। সরকারের দপ্তরে বিধবা বিবাহ আইনের বিপক্ষে তিরিশ হাজারেরও বেশি স্বাক্ষর সম্বলিত চিঠি জমা পড়েছিল। বিপক্ষকারীরা সাবধান করে জানান যে এই আইন ভারতে প্রচলিত হলে ধর্মদ্রোহ হবে। সহস্র প্রতিকূলতার পরও ২৬ শে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন শেষমেশ কার্যকর হয়। এই আইন পাশের পিছনে গ্র্যান্ড সাহেবেরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। কৃষ্ণনগরের রাজা শ্রীশচন্দ্র বাহাদুর, পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ, পন্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতীর সঙ্গে গ্র্যান্ড সাহেবের বাংলোয় গিয়ে  তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এলেন। সমাজের ভয়কে অবজ্ঞা করে এগিয়ে এলেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। বিধবা বিবাহের সমর্থনে অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে নাটকেরও আসর বসতে থাকে। বিধবা বিবাহের সপক্ষে জনসমর্থন ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়লো সারা বাংলা জুড়ে। 

অবশেষে ১৮৫৬ সালের ৭ ই ডিসেম্বর কলকাতার রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে বিদ্যাসাগর, রমাপ্রসাদ রায়, নীলকমল মুখোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামগোপাল ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর পলাশডাঙ্গার বিধবা কন্যা কালীমতীর সঙ্গে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিবাহ সম্পন্ন হয়। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ এই বিবাহ অনুষ্ঠান পন্ড করে দিতে চেয়েছিল কিন্তু বিশাল পুলিশ মোতায়ন থাকার জন্য তা সম্ভব হয়নি। এই বিবাহের পুরো খরচ বিদ্যাসাগর নিজে বহন করেছিল। শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সঙ্গে কালমতীর বিবাহের মধ্য দিয়েই বিধবা বিবাহ আইনের প্রচলন ঘটলো৷ যার ফলে বঙ্গদেশে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। 

তথ্যসূত্র- সববাংলায় ডট কম, অধ্যাপক ড. রামশঙ্কর প্রধানের গবেষণা পত্র, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান প্রথম খণ্ড।

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments