Header Ads

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তুর্কী সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত


বাঙালির বীরত্বের এক লম্বা ইতিহাস রয়েছে, যা এক কলমে লিখে শেষ করা যায় না। বিশ্বের প্রায় সমস্ত যুদ্ধেই অংশ নিয়েছিল বাঙালিরা। ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধেও সবচেয়ে বড়ো অবদান ছিল বাঙালির। যে সকল বাঙালিরা তার ক্ষমতা গোটা বিশ্বকে দেখিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম নাম হলো বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। এই নামটা হয়তো অনেক বাঙালিই শোনেননি৷ অথচ ইনি দেশ ও দেশের বাইরে কয়েকটি সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে ছিল অসীম দুঃসাহস। তিনি ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে তুর্কী সেনাবাহিনীর হয়ে লড়াই করেছিলেন।  


মাত্র অল্প বয়সেই বৈপ্লবিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হন বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন তিনি ১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেন একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। একদিন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এক ছাত্রকে বেত্রাঘাত করছিলেন কারণ সেই ছাত্রটি স্বদেশী করার জন্য বিলিতি কাপড় পুড়িয়েছে। তিনি এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেন। রাগে ও ক্রোধে সেই স্কুল পর্যন্ত ত্যাগ করলেন। তারপর চলে এলেন কলকাতায়। ১৯০৬ সালে কলকাতায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের পরিচালনাধীন শিক্ষালয়ে যোগ দেন। এই শিক্ষালয়টি বর্তমানের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর ভাগ্য এতোটাই ভালো যে তিনি ছাত্রাবস্থায় শিক্ষক হিসেবে পেলেন ঋষি অরিন্দম ঘোষ, বিনয় ঘোষ, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও রাধাকুমুদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিক্ষকদের। এখানেই তিনি ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের ছায়াতলে বিপ্লবী রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন৷ তিনি ছাত্র হিসেবে এতোটাই মেধাবী ছিলেন যে সেকেলে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা যাত্রা করেন এবং পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন৷ 

১৯১৪ সালে তিনি পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে শিকাগোতে চাকরি করতে গেলেন। এই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আমেরিকায় ভারতীয় বিপ্লবীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তৎপর হন এবং তিনি সেই দলে যোগ দেন। তারপর গোপনে জার্মান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করে 'মির্জা আলি হায়দার' ছদ্মনামে তিনি পাসপোর্ট নিয়ে দুঃসাহসিক পথে রটারডেম হয়ে বার্লিনে পাড়ি দিলেন ১৯১৪ সালের শেষার্ধে। সেখানে ব্রিটিশ কাউন্সিলের অনুমতি ছাড়াই তিনি সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেন। 

প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের নিয়ে গঠিত বার্লিন কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি বার্লিন কমিটির অন্যতম প্রধান মৌলানা বরকতুল্লাহর সেক্রেটারি হিসেবে আলেপ্পো ও জেরুজালেম যান। সেখান থেকে তুর্কী সৈন্যদলের হয়ে সিনাই মরুভূমি ও সুয়েজ খালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধে তিনি আহত হয়ে সুইজারল্যান্ডে সাত বছর কাটান।

সুইজারল্যান্ডে থাকাকালীন ১৯২১ সালে এক জার্মান ব্যবসায়ীর সঙ্গে ইন্ডো-সুইস ট্রেডিং কোম্পানি স্থাপন করে তিনি দেশে ভাইদের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। আর সেখানকার কয়েকটি পত্রিকাতে তিনি ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৯২৪ সালে তিনি দেশে ফিরলেও ব্রিটিশ পুলিশের তাড়নায় দেশ ছেড়ে জার্মানি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন৷ 

১৯২৬ সালের শেষ দিকে বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত জড়িয়ে পড়েন নতুন এক ধরনের কাজে। খুব সম্ভব ইতিমধ্যে তিনি যোগ দিয়েছিলেন জার্মান কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯২৭ সালের ১০ থেকে ১৫ ই ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসে যে 'ঔপনিবেশিক অত্যাচার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সম্মেলন' অনুষ্ঠিত হয় তিনি ছিলেন তার প্রধান উদ্যোক্তা। এই সম্মেলনে যে 'সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং জাতীয় স্বাধীনতার সমর্থক সংঘ' গঠিত হয় তিনি পরবর্তী কালে তার সম্পাদকও হয়েছিলেন জার্মান কমিউনিস্ট মুনজেনবার্গের সঙ্গে। এ আন্দোলনে ও সংঘে তখন সমবেত হয়েছিলেন বহু দেশের কমিউনিস্ট ও জাতীয় আন্দোলনের প্রতিনিধিবর্গ। 

১৯৩২ সাল থেকে হিটলারের গুন্ডাবাহিনীর উপদ্রুব উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে জার্মানিতে। 'সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী' সংঘে'র দপ্তরের কাছেই আবার ছিল মস্ত এক নাৎসী ঘাঁটি। যে-কোনো সময় দপ্তরের উপর হামলার ও বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের প্রাণহানির আশঙ্কা করে জার্মানির তদানীন্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ভ্যাভরোস্কি তাঁকে অবিলম্বে জার্মানি ছেড়ে সোভিয়েত দেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এই পরামর্শ যে কত সঠিক ছিল তা বোঝা যায় এই থেকে যে বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত জার্মানি ছাড়ার অল্প সময়ের মধ্যেই নাৎসী বাহিনী সংঘের সমস্ত কাগজ ও জিনিসপত্র হামলা চালিয়ে তচনচ করে ফেলে। ১৯৩৭ সালে হিটলারের রোষানলে পড়ে একমাস হামবুর্গের আন্ডারগ্রাউন্ড সেলে কাটাতে হয় তাঁকো। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশে ফিরে আসেন তিনি৷ ১৯৫০ সালে সেবামূলক কাজের জন্য নদীয়াতে তিনি একটি সর্বোদয় আশ্রম প্রতিষ্ঠা করছিলেন। এমনকি বিনয় সরকার ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্স নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

তথ্যসূত্র- সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, রুশ বিপ্লব ও প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী- চিন্মোহন সেহানবীশ। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments