Header Ads

কেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিন বাংলার জাতীয় শিক্ষক দিবস হওয়া উচিৎ?


শিক্ষক, যিনি শিখিয়ে দেন জীবন-দর্শন, বুঝিয়ে দেন জীবনের সকল অর্থ আর নির্দেশিত করেন এক সঠিক পথ। পৃথিবীর আলো দেখার পর মাতা-পিতা, আত্মীয়-পরিজন, এই পৃথিবী প্রকৃতি, ও তার পরেই আসেন কিছু বিশেষ মানুষ যারা আমাদের নিরন্তর শিখিয়ে চলেন, বুঝিয়ে চলেন ও দেখিয়ে দেন পথ --- যে পথের শেষে সেই জাতক নিজেও একজন সু-শিক্ষক হয়ে ওঠেন। অবশ্যই 'সময়', 'ইতিহাস' ও 'অভিজ্ঞতা' এই তিন মহান শিক্ষককেও আমরা ভুলে যেতে পারিনা। আমরা সত্য‌ই "সবার আমি ছাত্র"।


শিক্ষক দিবস পালিত হয় পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই। মহান শিক্ষকদের জন্য উৎসর্গ করা হয় একটি বিশেষ দিন। শিক্ষকদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই; প্রতিটি দিনই "শিক্ষক দিবস" প্রতিটি দিনই "শিক্ষা দিবস", তবে একটি বিশেষ দিনে বিশেষ ভাবে তাঁদের স্মরণ করা হয় --- শিক্ষক দিবস।

আমাদের দেশে যে দিনটি শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিতর্ক থাকুক, বিতর্ক থাকা উচিত। বিতর্ক মানুষকে সমৃদ্ধ করে, জানার পথ সুগম করে। বিতর্কের তুল্যমূল্য আলোচনার পরেই নতুন ভাবনার সৃষ্টি হয়। নব নব ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু ও অভিমুখ তৈরি হয়। বিতর্ক মেনে নিতে না পারলে এগুনোর পথ রুদ্ধ হয়। আর "যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে, অসংখ্য শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে।" 

কিন্তু বর্তমান নিবন্ধে সেই বিতর্কের আশপাশ দিয়েও আমি যেতে চাইছি না। 

আমার বক্তব্য --- ভারত ভিন্ন ভিন্ন জাতির এক মহা জাতিসংঘ। আর পৃথিবীর সমস্ত জাতিতেই কিছু মানুষ থাকেন বা আসেন, যারা সেই জাতিকে গড়ে পিটে সভ্য জাতে পরিণত করেন। সৃষ্টি করেন সেই জাতির জন্য নিজ সংস্কৃতি, ভাষার গতিপথ ও ভাবনা। আমাদের দেশেও প্রায় প্রতিটি জাতিতেই রয়েছে বিভিন্ন মানুষের অবদান এবং সেই অবদান এতটাই সুদুরপ্রসারী যে তাদের জাতির শিক্ষক হিসেবে মেনে নিতে দ্বিধা নেই। এঁরা শুধুমাত্র স্কুল-কলেজে পাঠ দান করে জীবন কাটিয়ে দেন না, এঁরা সমাজের সমস্ত কলুষ দূরীভূত করে সমাজের ঘাড় ধরে সমাজকে সুশিক্ষা দান করেন। তাই এঁরা নেহাতই স্কুল-কলেজের শিক্ষক নন, এঁরা জাতির শিক্ষক। প্রতিটি জাতি তার নিজ নিজ শিক্ষকদের, মূলত বলতে চাইছি জাতির সমাজ শিক্ষকদের স্মরণ করুন শ্রদ্ধায়। 

বাংলায়, পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেগম রোকেয়া সহ অগুনতি মহান শিক্ষক এই জাতিকে রূপদান করেছেন। মহারাষ্ট্র যেমন জ্যোতিরাও ফুলে, সাবিত্রীবাই ফুলে সমাজের দলিত-মথিত মানুষের প্রয়োজনে সারা জীবন দান করেছেন, নারী শিক্ষা ও বিধবাদের জন্য বিভিন্ন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন অকাতরে। এভাবেই আমরা প্রতিটি জাতির মধ্যেই জাতীয় শিক্ষকদের খুঁজে পাই।

প্রতিটি জাতিই আরো বেশি সংখ্যক শিক্ষক দিবস পালন করুক। এভাবেই জাতির শিক্ষকদের কাজগুলি ও আত্মত্যাগের ইতিহাস ফিরে দেখা হোক। স্মৃতিচারণের মাধ্যমে আগামীর পথনির্দেশনা খুঁজে নেওয়া হোক। হীনমন্যতা কাটিয়ে ধার করা দিবস পালন না করে, বা তার পাশাপাশি পালিত হোক নিজেও জাতির শিক্ষকদের জন্যেও একটি দিবস। আত্মগরিমা গড়ে উঠেবে এতে। নিজেও জাতির প্রতি সম্ভ্রম গড়ে উঠবে এতে। অনুরোধ, সকলেই একবার ফিরে তাকিয়ে দেখুন আপনার নিজের জীবনে স্মরণীয় শিক্ষক কারা, আপনার জাতি ও আপনার দেশের বা রাজ্যের স্মরণীয় শিক্ষক কারা, আপনার রাষ্ট্রের ও পৃথিবীর মহান শিক্ষক কারা --- তাঁদের স্মরণ করে "নতুন মানব সমাজ" গড়ে তুলতে কোন দ্বিধা থাকার কারণ তো নেই।

"বাংলার জাতীয় শিক্ষক দিবস" হয়ে উঠুক ২৬শে সেপ্টেম্বর। পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিন এটি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পুরো জীবনটাই আমাদের কাছে এক মহান শিক্ষা। তিনি তার সারাটা জীবন দান করেছেন সমাজের উত্তরণের লড়াইয়ে। শিক্ষার প্রচার এবং প্রসার ও বিস্তারে। বিধবা বিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ রোধ, বাল্যবিবাহ রোধ --- সহ সমাজের বিভিন্ন ক্লেদ ধুয়ে ফেলতে নিরন্তর লড়াই করে গেছেন নিজের সম্প্রদায়ের অপরাপর 'পণ্ডিত'দের সঙ্গে। সমাজ তাঁকে অপমান করেছে, মৃত্যুমুখে পতিত করেছে, তাঁর পিছনে ঢাকঢোল পিটিয়ে অপমানজনক গান গাইতে গাইতে থাকে অনুসরণ করেছে রাস্তায়; কিন্তু তিনি তাঁর নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন, জয় না আসা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হন নি। এহেন সমাজ শিক্ষক সারা পৃথিবীতে আরেকটি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। নারী শিক্ষার বিস্তারে একের পর এক স্কুল খুলেছেন। যে সময় বাইরে যাওয়া দূরের কথা, মেয়েদের ঘরে বসেও লেখাপড়া ছিল নিষিদ্ধ, সে সময় তিনি ২৮৮ টি স্কুল খুলেছিলেন বাংলায়, বালিকা বিদ্যালয়। বাংলা গদ্যরূপ-এর সংস্কার, লিপি সংস্কার থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যকে জনপ্রিয় করে তুলতে তার অবদান অবিস্মরণীয়। শিশুদের যাতে লেখাপড়া সুগম হয়, নীতিবোধ গড়ে ওঠে তার জন্য তিনি একের পর এক শিশুপাঠ্য গ্রন্থাবলী রচনা করেছেন। সঠিক পদ্ধতিতে ছেপে বের করার জন্য প্রকাশনা সংস্থা ও মুদ্রণ সংস্থা খুলেছেন। এমনকি শহুরে বুদ্ধিজীবীদের নাটুকেপনায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে যখন কার্মাটরে চলে গেলেন সেখানেও আদিবাসীদের জন্য শুরু করলেন স্কুল ও তাদের চিকিৎসার জন্য হোমিও প্রাক্টিস। তাঁর রচিত "উইল" বা "ইচ্ছাপত্র" যে-কোনো মানুষের কাছে অনুপ্রেরণামূলক হতে পারে। মৃত্যুর পরেও তাঁর সমস্ত সম্পত্তি কিভাবে সমাজের সেবা করে যাবে নিরন্তর, তার ব্যবস্থা তিনি সেই ইচ্ছাপত্রে উল্লেখ করে গিয়েছিলেন। 

একটা জীবনে এত কিছু? অবিশ্বাস্য হলেও এটাই বাস্তব।

এ আলোচনার পরে, দ্বিধা থাকার কোন জায়গা নেই, "বাংলার জাতীয় শিক্ষক পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর"। আর বাংলার জাতীয় শিক্ষক দিবস হয়ে উঠুক "২৬ সেপ্টেম্বর"।

পাঠক, আপনার মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।

প্রতিবেদন- অরিন্দম চন্দ্র


1 comment:

  1. ধন্যবাদ জানাই আন্তরিক।

    ReplyDelete