ব্রিটিশদের নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগরের লড়াইকে সমর্থন করেছিল বাঙালি সমাজ
চটি জুতো পরে এশিয়াটিক সোসাইটির জাদুঘরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় জীবনে আর দ্বিতীয়বার ওই প্রতিষ্ঠানের ছায়া মাড়ান নি। ঠিক তেমন তাঁর ছাত্র শিবনাথ শাস্ত্রীকে বাইরে চটি খুলে তবেই শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিক উড্রো সাহেব তাঁর হাতে চিঠি তুলে দেওয়ার কথা বললেও তিনি সেই আদেশ মানেন নি৷
১৮৫৬ সালের ৭ই ডিসেম্বর প্রথম ঐতিহাসিক বিধবা বিবাহ নিজের চোখে দেখেছেন শিবনাথ শাস্ত্রী, রাজকৃষ্ণ ব্যানার্জির সুকিয়া স্ট্রিটের ভবনে প্রথম বিধবা বিবাহের সেই স্মৃতি তাঁর জীবনে চির উজ্জ্বল হয়েছিল৷ যিনি নিজেই বলেছেন জীবনে সর্বপ্রথম যে বিরাট ব্যক্তিত্বশালী পুরুষের সংস্পর্শে এসেছেন তিনি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর৷ ধুতি, চাদর, চটিজুতো পরে বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষ বিদ্যাসাগর মহাশয় লাটভবন পর্যন্ত যেতেন, কিন্তু সেবার হল কি, কবি ভারতেন্দু হরিশচন্দ্র ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নামের দুই যুবকের সাথে ১৮৭৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জাদুঘর দেখতে গিয়েছেন, অন্য দু'জনের পরিধানে প্যান্ট, কোর্ট, বিলাতি জুতো। অতএব প্রবেশে বাধা এল না, কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আটকে দিল দারোয়ান, বললেন চটিজুতো খুলে ভিতরে যেতে হবে। বিদ্যাসাগর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে সেখান থেকে বেরিয়ে অপেক্ষামান গাড়িতে সঙ্গীদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন৷
সোসাইটির সম্পাদক প্রতাপচন্দ্র ঘোষ ছুটে এসে তাঁকে জোড়হস্তে ভিতরে যাবার অনুরোধ করলে তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখান করে বললেন সবার জন্য এক নিয়ম তাঁর জন্য অন্য নিয়ম হতে পারে না৷ যতদিন চটিজুতো পরে সবাই ভেতরে যেতে পারবে না, ততদিন তিনি ভিতরে যাবেন না৷ এই নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হলেও ইংরেজ সরকার সর্বসাধারণের জন্য প্রচলিত নিয়ম তুলে না দিতে সন্মত না হওয়ায় বিদ্যাসাগর মহাশয় জীবনে আর কোনওদিন এশিয়াটিক সোসাইটির ছায়া মাড়ান নি৷
শিবনাথ শাস্ত্রী যখন সংস্কৃত কলেজের ছাত্র তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই কলেজের অধ্যক্ষ৷ প্রথম থেকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সমর্থক হিসেবে সমাজে নানা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেছিলেন৷ এর নেপথ্যে হয়তো অনেক কারণের একটি শাস্ত্রী মহাশয়ের মাতুল দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহপাঠী এবং পিতৃদেব শ্রীযুক্ত হরানন্দ বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সতীর্থ ছিলেন৷ মিস্টার উড্রো তখন সরকারি বিদ্যালয়ের পরিদর্শক, অন্যদিকে শিবনাথ শাস্ত্রীর বাবা গ্রামের বিদ্যালয়ের হেড পণ্ডিত৷
বাবার দেওয়া একটি চিঠি পৌঁছে দিতে সাহেবের অফিসে পৌঁছলেন শাস্ত্রী, সাহেব তখন প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করছেন, কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর উড্রো সাহেব পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন যেখানে শাস্ত্রী মহাশয় অপেক্ষা করছেন, তিনি নমস্কার জানিয়ে চিঠিটি সাহেবের হাতে তুলে দিতে গেলে তাঁকে আপাদমস্তক লক্ষ্য করে চিঠিটি গ্রহণ করলেন না, বরং বিরক্তিকর ভাবে শাস্ত্রী মহাশয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন৷ সামান্য কয়েকটি মুহূর্ত অপেক্ষার পর উড্রো সাহেব বললেন তুমি চটিটি ঘরের বাইরে খুলে রেখে এসে তারপর আমার হাতে চিঠি দাও৷ কিন্তু চিঠির সাথে চটির কি সম্পর্ক শিবনাথ অত বুঝলেন না! কাজেই সেই প্রস্তাবে তিনি সন্মত হলেন না, এবার শুরু বাকবিতণ্ডা৷
উড্রো বললেন অপমান করছো আমাকে!
অবাক হয়ে শিবনাথ বললেন আপমানের কি হল!
উড্রো আরও রেগে বললেন পায়ের চটি না খুলে চিঠি দেওয়াটা তিনি অপমান মনে করেন৷ সাহেবের এসব কথা শুনে কিশোর শিবনাথের হৃদয়ে স্বাদেশিকতা বোধ আরও জাগ্রত হল, তিনি সাহেবের কেরানীর পায়ের দিকে সঙ্কেত করে বললেন সাহেব তোমার কেরানীও দেখছি জুতো পরেই তোমার সামনে চলাফেরা করে, এতে তুমি অপমানিত বোধ করছো না?
সাহেব অবশ্য তার যুক্তিতে অনড়, একই অবস্থান শিবনাথ শাস্ত্রীর, তিনি বললেন সাহেবের কথায় যুক্তি নেই। অতএব চটি খুলে আসবেন না৷ সাহেব যুক্তিতে না পেরে শিবনাথ শাস্ত্রীকে বললেন তুমি দেখছি খুব অবাধ্য, তুমি কোথায় পড়?
উত্তর এল, সংস্কৃত কলেজের প্রথম বার্ষিক শ্রেণীতে৷ অবশেষে সেই চটি পরেই বাবার পাঠানো চিঠিখানি সাহেবের টেবিলে রেখে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন৷ এই ঘটনায় ভাগ্নের প্রতি অতিশয় প্রীত হয়েছিলেন মাতুল দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ 'সোমপ্রকাশ' পত্রিকায় সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইংরেজদের হীন মানসিকতার তীব্র প্রতিবাদ করেন৷
সংবাদটি উড্রোর কাছে গেলে তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষা দপ্তরে নোটিশ দেন যেন কোনওদিন শিবনাথ শাস্ত্রী শিক্ষা দপ্তরের অফিসে প্রবেশের অনুমতি না পান৷ মামা শুধু এখানে থামেন নি শাস্ত্রী মহাশয়ের জীবনের পরের দিকেও বলেছেন' বিশেষ করে আমার ভাগ্নে হয়ে তুমি মানুষের বিপদের সময়ে কেবলমাত্র আচার-অনুষ্ঠানের ভয়ে সরে আসবে, এ আমি দেখতে চাইনা৷ লোকাচার ও সংস্কার অপেক্ষা কর্তব্য অনেক বড় বস্তু৷ কখনো তা হতে বিচ্যুত হবে না'৷
প্রতিবেদন- অরুণাভ সেন
তথ্যসূত্র- বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ : বিনয় ঘোষ, মহাপুরুষদের সান্নিধ্যে (Men I have seen'থেকে অনূদিত): শিবনাথ শাস্ত্রী; অনুবাদিকা: মায়া রায়
Post a Comment