বাঙালিরা যাতে সিভিল সার্ভিস না পায়, তার জন্য বিল পাশ করেছিল ব্রিটিশরা
বাঙালিকে ব্রিটিশরা বার বারই ভয় পেতো। বাঙালির ক্ষমতা, শিক্ষা, আন্দোলন ব্রিটিশদের ত্রাসের কারণ ছিল। যে কারণে বেঙ্গল রেজিমেন্টকে চালানোর সাহস পায়নি ব্রিটিশরা। ঠিক তারপরই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বাঙালির সুযোগ পেয়ে যাওয়াকে বেশ সমস্যার মনে করেছিল ব্রিটিশরা। যেহেতু এই পরীক্ষাটিতে কারা পাবে তা সবসময়ই ব্রিটিশদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রিত ছিল। রাজ্য সরকারের ক্ষমতা খর্ব করার একটি সহজ পদ্ধতি ছিল ইংরেজ নিয়ন্ত্রিত এই সব আমলারা বা সিভিল সার্ভেন্টরা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই সরকার আমলাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। বাস্তবিকভাবেই সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনো ক্ষমতাই থাকেনা আমলাদের, ব্রিটিশ সময় হোক বা বিভিন্ন দেশের ইতিহাস সব জায়গাতেই এই ঘটনা ঘটে। ব্রিটিশরা বাঙালিদের এই কাজে আসাকে তবুও বার বার ভয় পেত। বর্তমানে বেশিরভাগ দেশেই ফ্রি রাইডার প্রবলেম, কালেক্টিভ অ্যাকসেন প্রবলেমের মতো সমস্যায় জেরবার থাকে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলো।
ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের মতো সংস্থাগুলির বহু রিপোর্ট অনুযায়ী আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংস্কারের অনীহা দেখা যায় বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। ইনডিড, রোস্তেইন, তেওরেল, পারসোনের মতে -'Civil services reforms have failed as a result of their Mischaraterization of corruption'.
বহুজাতিক দেশে যে জাতির ক্ষমতা বেশি সেই জাতির লোক এই সমস্ত পরীক্ষায় লবি তৈরিতেও সমর্থ্য হয় বিশ্বের ইতিহাসে এর বহু নজির আছে। বাস্তবে পৃথিবীর কোনো পদই সন্দেহের উর্দ্ধে নয়।
উদাহরণ স্বরূপ ১৮৬১ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট পাশ হয় এবং ১৯৬৩ সালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে সিভিল সার্ভিস হন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ হওয়ার পর সারা ব্রিটেন জুড়ে তার সমালোচনা করা হয়। এমনকি এই পরীক্ষা পাশের উর্দ্ধসীমা হিসেবে ২১ বছর করে দেওয়া হয় যে কারণে ঐ বছর মনমোহন ঘোষ এই পরীক্ষায় পাশ করেও বাতিল হয়ে যান। যোগেশ চন্দ্র বাগালের 'History of the Indian Association' বইটিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দাদাভাই নৌরজি এ নিয়ে আন্দোলনও করেন। যেহেতু সিভিল সার্ভেন্ট ধারণাটাই তৈরি হয়েছিল ব্রিটেনে এবং এই পদে বাঙালি তথা ভারতীয় ঢোকার ব্যাপারে তারা বিরোধীতা শুরু করে। এই বিরোধিতার অর্থ হলো এই সমস্ত আমলারা ছিল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত, কাজেই প্রশ্ন তুলবে এমন জাতির আমলা না থাকায় ছিল ব্রিটিশদের জন্য সুবিধাজনক। ১৯২১ সালের ৮ ই নভেম্বর 'বিজলী' পত্রিকায় বারীন্দ্রকুমার ঘোষের লেখা থেকে পাওয়া যায় - 'অনেকদিন ধরেই ভারতীয়দের, বিশেষত শিক্ষা-দীক্ষায় ভারতের অন্য প্রদেশ থেকে অগ্রগামী বাঙালিদের উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ করার চক্রান্ত বিলাতের কর্তৃপক্ষ মহলে শুরু হয়েছিল'।
তখনকার ভারতের বড়লাট লর্ড মেয়ো তাঁর একটি পত্রে লেখেন - 'If you wait till the bad English, which the four hundred Babus learn in Calcutta, filters down into the 40 millions of Bengal, you will be ultimately a Silurian rock instead of a retire judge. Let the Babu learn English by all means. But let us also try to do something towards the three R's to do Rural Bengal'.
গ্রামে শিক্ষা বিস্তারের অজুহাতে তখন শহরে বাঙালির উচ্চশিক্ষার বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয় একই সঙ্গে গ্রামেও শিক্ষা বিস্তার বন্ধ রাখা হয়। 'Govt of India's resolution on September,1869' এর মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের কাজগুলো কমিয়ে দেওয়া শুরু হয়। এ নিয়ে সারা বাংলায় প্রতিবাদ শুরু হয়। এভাবেই যুগে যুগে শাসকরা বাঙালিকে ভয়পেয়ে আসে। কোনো শাসকই প্রতিবাদী লোককে আমলারূপে দেখতে চায়না। কোনো দেশই বাস্তবে তার ব্যতিক্রম নয়।
প্রতিবেদন- অমিত দে
তথ্যসূত্র- কলকাতার গুপ্ত সমিতি: উনিশ শতক; প্রতাপ মুখোপাধ্যায়
Post a Comment