Header Ads

বিভাবন আয়োজিত জাতীয় অন্তরঙ্গ নাট্য উৎসব 'ব্রিজ বিটুইন আস'


বিভাবন এর শুরু ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে, গত বছর ডিসেম্বর মাসে তাদের নাট্যদল ২৪ বছর পেরিয়ে ২৫ বছরে পা দিয়েছে।

১৯৯৬ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এর নাটক বিভাগের কিছু ছাত্ররা মিলে তৈরি করে বিভাবন। উদেশ্য ছিল নিজেদের কথা নিজেরা বলবো। তারপর দেখতে দেখতে তারা ৪৩ টা নাট্য প্রযোজনা করে ফেলেছে। অন্তরঙ্গ নাট্য নিয়ে তাদের চর্চা শুরু থেকেই। নাটক প্রযোজনার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে তারা আয়োজন করেছে নাট্য বক্তৃতা, নাট্য আলোচনা, নাট্যশালা ও প্রকাশ করে আসছে তাদের মুখপত্র বিভাবন। গত ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়ে তাদের প্রকাশনার সংকলন "এ সময় তোমার এ সময় আমার"। গত বছর নভেম্বর মাসে বিভাবন থেকে প্রকাশিত হয়েছে সুপ্রিয় সমাজদার এর প্রায় দু দশক ধরে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত নাট্য প্রবন্ধের সংকলন "আসলে বিকল্প বলে কিছু হয় না"।


বিভাবন প্রথম নাট্য উৎসব করে ১৯৯৮ সালে, তারপর ২০০২ সাল থেকে অন্তরঙ্গ নাট্য উৎসব, বিভিন্ন সময় এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে ওয়াই এম সি এ, কলেজ শাখা পদাতিক, তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহ, প্রসেনিয়াম আর্ট সেন্টার ও থিয়ে এপেক্সে।

এ বছর বিভাবন এর ২৫ বছর চলাকে সঙ্গে নিয়ে গত ৯-১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ জাতীয় অন্তরঙ্গ নাট্য উৎসব "ব্রিজ বিটুইন আস" অনুষ্ঠিত করেছিল থিয়ে এপেক্স, দমদমে। 

বিভাবন-এর আয়োজনে চার দিন ব্যাপী জাতীয় অন্তরঙ্গ নাট্যোৎসব "ব্রিজ বিটুইন আস" ৯-১২ ই সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হল থিয়ে এপেক্স-এ। চার দিনে ছিল কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা ও ওড়িশার মোট সাতটি নাটক। এছাড়াও কর্মশালা এবং নাট্য বিষয়ক আলোচনার মধ্যে দিয়ে জমজমাট ছিল এই চারটি দিন। বিভিন্ন দিনে বহু বিদগ্ধ মানুষের উপস্থিতি যেমন আশিস গোস্বামী, সুবোধ পট্টনায়ক, প্রবীর গুহ, কুন্তল মুখোপাধ্যায় এই উৎসবকে সাফল্যমন্ডিত করে তুলেছিল। 

এই উৎসবের প্রথম দিন অর্থাৎ ৯ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬ টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রদীপ প্রজ্জলনের মধ্য দিয়ে শুভ সূচনা হয়। উদ্বোধন করেন কেরালার লোকধর্মী নাট্যদলের নির্দেশক শ্রী চন্দ্র দাসন, শোহন নাট্যদলের নির্দেশক শ্রী অনীশ ঘোষ এবং  বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ও নাট্য নির্দেশক তথা বিভাবন-এর সভাপতি শ্রী শেখর দাস। বিভাবন এর পক্ষ থেকে অতিথিদের উৎসবের স্মারক দিয়ে বরণ করে নেন সুপ্রিয় সমাজদার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর চন্দ্র দাসন তার সংক্ষিপ্ত ভাষণে "ব্রিজ বিটুইন আস" জাতীয় অন্তরঙ্গ নাট্য উৎসবে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য তিনি বিভাবন এর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান, অনিশ ঘোষ তার ভাষণে বিভাবনকে শুভেছা জানান অন্তরঙ্গ নাটক নিয়ে তাদের জাতীয় স্তরে এই উৎসবে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। তিনি বলেন এই উদ্যোগ আগামী দিনে অন্তরঙ্গ নাট্য চর্চার আরো প্রসার ঘটবে ভারতবর্ষে, শেখর দাশ তার বক্তব্যতে বলেন, বিভাবন এ বছর তার থিয়েটার নিয়ে ২৫ বছর উদযাপন করছে, শুরু থেকেই তারা অন্তরঙ্গ নাট্য চর্চার সাথে যুক্ত, জাতীয় স্তরে এই অন্তরঙ্গ নাট্য উৎসব এই চর্চাকে আরো প্রসারিত করবে, যা থিয়েটারের নতুন ভাষার সন্ধান করবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বিভাবন নাট্য দলের নাটক "ভালোবাসার গান" উপস্থাপিত হয়। নির্দেশনা শ্রী সুপ্রিয় সমাজদার। বিজয়া কর্মকার, মানসী কুন্ডু, ঈশান কর্মকার, অনির্বান পৈতন্ডি, শ্রীজিতা সাহা, ভক্ত দাস বাউল, শিবু বাউল, সোমা গিরি ও কাজল হাজরা'র অংশগ্রহণ এই নাটকের একটি বিশেষ দিক। এই নাটকে ভরত নাট্য শাস্ত্র থেকে "যম যমী কথা" নাটকটির অংশ ব্যবহৃত হয়েছে। বাউল গানের ব্যবহার হয়েছে, পেইন্টিং এর ব্যাবহার করা হয়েছে। এছাড়াও নৃত্যের ব্যবহার আছে। নির্দেশক বেশ কিছু ইমেজের ব্যবহার করেছেন এই নাটকে, যা মানুষের জীবনের সম্পর্কের নানা দিককে তুলে ধরে। শ্রী শেখর দাস বলেন এই নাটক তাকে তার ছোট বেলার অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে। চন্দ্র দাসন বলেন, তিনি বাংলা ভাষায় সংলাপের মানে না বুঝলেও এই নাটকে বাউল গান, নৃত্য, রঙের ব্যবহার তার ভালো লেগেছে, নতুন ভাষার সন্ধান দেয় এই নাটক। অনিশ ঘোষ তার প্রতিক্রিয়া তে বলেন, এই নাটকের সামগ্রিক ভাবনা, বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের বাবহার তার ভাল লেগেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং একটি নাটকের উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে উৎসবের প্রথম দিনের পরিসমাপ্তি ঘটে। 

১০ই সেপ্টেম্বর এই অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে উপস্থাপিত হয় দুটি নাটক। কিন্তু তার আগে সকাল ১১টা দুপুর ১.৩০ পর্যন্ত "ল্যাঙ্গুয়েজ অফ অ্যাক্টিং"-এর উপর মাস্টার ক্লাস নেন শ্রী চন্দ্র দাসন। সন্ধ্যা ৬টায় উপস্থাপিত হয় দ্বিতীয় দিনের প্রথম নাটক "মালদা আগামী" নাট্যদলের "এন অড টু নানা-গম্ভীরা"। মালদা জেলার ঐতিহ্য গম্ভীরাকে এক নতুন রূপে পরিবেশন করেছেন নির্দেশক যেখানে বর্তমান সময়ের কথা উঠে এসেছে। নানান বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে প্রযোজনাটি হয়ে উঠেছে প্রাণোচ্ছল। নাটকটির ভাষায় বাংলার মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। এই প্রযোজনাটির নির্দেশনা দিয়েছেন শ্রী জয়ন্ত বিশ্বাস। দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয় নাটক রূপে উপস্থাপিত হয় "নটমন" নাট্যদলের নাটক "কৃষ্ণকথা", নির্দেশনা শ্রী তমাল সেন। একক অভিনয় করেন সঞ্জীব মুখার্জি।ফুলমনি নামক একটি মেয়ের জীবন নিয়ে নাটকটি রচিত। আদিবাসী জীবনের কথা, এক শিল্পীর, চিত্রকরের তার সময়ে নতুন দিনের স্বপ্নের কথা এই নাটক, শেষে শিল্পীর চোখ আঁকার দৃশ্যটি ভালো লাগে। এই দুটি নাটকের উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে। 

অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিন অর্থাৎ ১১ই সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিনের সূচনা হয় দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মশালা-এর মধ্য দিয়ে। তারপর সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় দুটি নাটক। তৃতীয় দিনের প্রথম নাটক "থিয়েটার সাইন" নাট্যদলের "পোস্টমাস্টার", নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাদের খুব পরিচিত একটি গল্পকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে আমাদের সামনে পরিবেশন করলো থিয়েটার সাইন। নাটকের আলো, আবহ থেকে শুরু করে সেট, প্রপস সবের মধ্যেই নতুনত্ব আছে। চেনা গল্প কে অচেনা করে তোলে। এছাড়াও প্রত্যেকের অভিনয়ও আলাদা করে মনে রাখার মত। নাটকে গানের ব্যবহার ভালো লাগে তবে শেষে "এক মন তার সেই যেতে পারে" এই গানটির ব্যবহার সামগ্রিক প্রযোজনার ক্ষেত্রে সুর ব্যাহত করে।

দ্বিতীয় নাটক উপস্থাপিত হয় "প্রাচ্য" নাট্যদলের নাটক "বুদ্ধিজীবীর ময়নাতদন্ত", এই নাটকটি নির্দেশনা করেছেন শ্রী রাজীব বর্ধন। ব্যক্তির প্রেম এবং রাজনৈতিক আদর্শ তার জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করে তা দেখা যায় এই নাটকে। 

চতুর্থ দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় নাট্য কর্মশালা থেকে তৈরি একটি নাটক দিয়ে, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার এর "টেম্পেস্ট" থেকে চন্দ্র দাসনের পরিচালনাতে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা উপস্থাপিত করেন "ক্যালিবান কথা-এ ট্রেইলার" শেষে সবাইকে শংসাপত্র দেওয়া হয়। এরপর ছিল নাট্য আলোচনা। বিষয় "রেলিভেন্স অফ ইন্টিমেট থিয়েটার" বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রী চন্দ্র দাসন, শ্রী দক্ষা শর্মা, শ্রী দেবাশীষ দত্ত, শ্রী অলোকপর্ণা গুহ, শ্রী কৃতি মজুমদার এবং আলোচনাটির পরিচালনায় ছিলেন শ্রী তমাল মুখার্জি। অন্তরঙ্গ নাটকের বিভিন্ন দিক নিয়ে বক্তারা তাদের ভাবনা তুলে ধরেন। চতুর্থ দিনের প্রথম নাটক উপস্থাপিত হয় বিভাবন নাট্য দলের "একটি ডেটের গল্প", নির্দেশনা শ্রী সুপ্রিয় সমাজদার। এই সময়ে আমরা নিজেকে কিভাবে খুঁজে নিতে চাইছি, যা করছি সবটাই কি বাইরে থেকে নাকি ভেতরেও কিছু আছে। এই রকম অনেক প্রশ্ন এবং দুটি ভিন্ন বয়সী চরিত্রের আলাপচারিতা থেকে বন্ধুত্বে যেভাবে তারা এই সময়টাকে দেখছে তার কথা। নাটকে ব্যবহৃত মহীনের ঘোড়াগুলি'র গান এবং শ্রী হিরন মিত্রের সেট ডিজাইনের কথাও আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়। দ্বিতীয় নাটক রূপে উপস্থাপিত হয় ওড়িষার "উৎসব" নাট্যদলের নাটক উইকেন্ড, নির্দেশনা শ্রী দক্ষা শর্মা। দক্ষা শর্মা নিজের একক অভিনয়, প্রতিটি দর্শককে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন। এক অনিশ্চিত জীবনের কথা তুলে ধরেন তার প্রযোজনায় যেখানে তিনি যার সাথে সম্পর্কে আছে তার পূর্বে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। তাই এই মেয়েটিও প্রতি মূহুর্তে তাকে হারানোর ভয় পায়। সেখান থেকে উঠে আসে কিছু কথা। খুব সুন্দরভাবে গোটা ঘটনাটা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন দক্ষা। এই দুটি নাটকের উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে সমাপ্তি ঘটে বিভাবন আয়োজিত জাতীয় অন্তরঙ্গ নাট্যোৎসবের।

বিভাবন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও নির্দেশক সুপ্রিয় সমাজদার বলেন, "থিয়েটার মানুষের সাথে মানুষের সংযোগ স্থাপন করে আরো নিবিড় ভাবে, বিশ্বাস ফিরে পাক মানুষে মানুষে। যে সমস্ত নাট্যদল, বন্ধুরা পাশে থেকেছেন এই করোনাকালীন সময়ে - অসময়ে তাদের জন্য রইলো অনেক শুভেচ্ছা।"

প্রতিবেদন- নিজস্ব সংবাদদাতা


No comments