Header Ads

দু'চাকার যানবাহনে মহাতীর্থের শেষ যাত্রীর কৈলাশ যাত্রা || প্রথম পর্ব


দু'চাকার দুনিয়ায় ভর করে বাঙালি উপভোগ করেছে বিশ্বজয়ের স্বাদ। ভ্রমনপিপাসু বাঙালিদের পাহাড়, নদী-জঙ্গল, ঝর্ণা, জলপ্রপাত, মরুভূমি বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। তাই তো বাঙালিরা পাহাড়-পর্বত ও দেশভ্রমণের তাগিদে আজীবন অভিযান করে চলেছে। দুচাকার যানবাহনে চড়ে বাঙালির দেশভ্রমণের এক গৌরবময় ইতিহাস লুকিয়ে আছে। সাইকেলে করে বাঙালি কখনো লাদাখ, কখনো সাহারা আবার কখনো মানস সরোবর ভ্রমণ করেছেন। এমনই এক বাঙালির বিস্ময়কর ভ্রমণের কথা বলবো আজ। 


সালটা ১৯৫৬, বিদেশিদের জন্য তিব্বতের দরজা তখন প্রায় বন্ধ। ১৯৫১ সালের ২৩ শে মে চীনের 'সেন্ট্রাল পিপলস গভর্ণমেন্টে'র এক চুক্তি অনুসারে পিকিং সরকারের লিবারেশন আর্মি আস্তে আস্তে গোটা তিব্বতে ছড়িয়ে পড়ে। সে ঘটনা আমরা সকলেই জানি। রাজনৈতিক সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হবার পরও তীর্থযাত্রীদের জন্য কিছু কিছু পথঘাট খোলা ছিল৷ যার ফলে তিনি সাইকেলে করে তিব্বত অভিযানের মতো তৎকালীন সময়ের অসম্ভব কাজকে এক লহমায় সম্ভব করেছিলেন। তিনি হলেন বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি অভিযাত্রী বিমল দে। যিনি সাইকেলে করে তিব্বত অভিযান করেছিলেন। শুধু তিব্বতই নয়, সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া ঘুরে তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন। 

তীর্থযাত্রী বিমল দের চোখে তখন বিশ্বজয়ের নেশা৷ কিন্তু সেই বিশ্বজয় কীভাবে সম্ভব? সাত-পাঁচ চিন্তা বিরাজ করলো তাঁর মস্তিষ্কে। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সাইকেলের প্যাডেলে দম দিয়েই বিশ্বভ্রমণ করবেন। ব্যাস, সাইকেল হাতে পকেটে আঠারো টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বিশ্বভ্রমণে। এই ভ্রমণ কেবল যে নিছক ভ্রমণ তাও কিন্তু নয়, এটা একপ্রকার অভিযানই। বুকের মধ্যে অদম্য সাহস ও শরীরে লৌহবল না থাকলে এমন অভিযানে সফল হওয়া যায়না। তিনি অভিযানে সফল হবেন কী হবেন না এটা ভেবে বাড়ি থেকে বেরোন নি। তিনি শুধুমাত্র চেষ্টাটুকু করে গেলেন। তবে অনেকদিন থেকেই তিনি মনের মধ্যে এক বিশেষ ইচ্ছেকে পুষে রেখেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কৈলাশ খণ্ড তীর্থ। সমগ্র মানবজাতির পবিত্র তীর্থক্ষেত্র হলো কৈলাশ ধাম। কেউ কেউ এই জায়গাকে স্বর্গের দ্বারও বলে থাকেন।   
         
১৯৫৬ সালে তীর্থযাত্রীদের জন্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা হলো তিব্বতের দরজা। স্বভাবতই তীর্থযাত্রীদের আনাগোনা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু এক বাঙালির তখনও কৈলাশ অভিযানের জন্য যাত্রা চলছে। মহাতীর্থের শেষ যাত্রী হিসেবে তিনি রওনা দিয়েছেন সেই পথে। চীনারা তিব্বতে কী করছে বা না করছে তাতে তিনি পাত্তাই দিলেন না৷ মনে মনে কেবল ঈশ্বর-কে স্মরণ করলেন। আর বলতে লাগলেন "একজন সাধারণ তীর্থযাত্রী হিসেবে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছি এ দরজা যেন খুলে যায়৷ স্বর্গের দরজা কিছুতেই বন্ধ করা চলবে না-মানুষমাত্রেই কৈলাশ তীর্থের অধিকারী৷ স্বয়ম্ভু কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। সমস্ত মানব জাতির পবিত্র তীর্থক্ষেত্র এই কৈলাশ খণ্ড।" 

চীনা কর্তৃপক্ষ যখন লাথুলা ও অন্যান্য কৈলাশের পথ বন্ধ করে দেন তখন ভারতের সাধু-সন্ন্যাসী ও পরিব্রাজকেরা কৈলাশকে বাঁচানোর জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন। পরে অবশ্য ১৯৫৮ সালের দিকে কৈলাশের পথ খুলে দেওয়া হয়। কথিত আছে, বহু ধ্যান-পূজা, যজ্ঞের মাধ্যমে সাধু, জ্ঞানী ও গুণীজনেরা তাদের মনের কথা পৌঁছে দেন সেই পরম শিবের শ্রীচরণে৷ আজ কৈলাশ ও মানস সরোবরের পথে আবারও চলেছেন শত শত তীর্থযাত্রী। ভগবান নাকি তাঁর শিষ্যদের প্রার্থনা কান পেতে শুনেছেন।

ভ্রমণপিপাসু বিমল দে রুদ্ধশ্বাস গতিতে আপন মনে এগিয়ে চলেছেন। কৈলাশ ও মানস সরোবরের দৃশ্য স্বপ্নায়িত হয়ে তাঁর চোখে ভাসছে। তিব্বতের প্রধান সমস্যার কথা তিনি উড়িয়ে দিলেন। তিব্বতের সমস্যা তিব্বতের মানুষ বুঝে নেবে। তিনি তো নামেমাত্র একজন স্বয়ং পর্যটক। দর্শন তাঁকে আপাদমস্তক ধারণ করেছে। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তাঁকে পৌঁছতে হবে কৈলাশ খণ্ডে।   

প্রথমে তিনি এসে পড়লেন দার্জিলিং এ। তারপর সেখান থেকে একটি ট্রাকের মাথায় চড়ে উপস্থিত হলেন ভারতের শেষ সীমানা হিমালয়ের পাদদেশে। এই জায়গাটির নাম তিস্তা বাজার। মিলিটারি আর হাটবাজারের মালবাহী ট্রাকে বোঝাই একটি ছোট্ট কর্মব্যস্ত শহর হলো তিস্তা বাজার। এই শহরের পাশ দিয়ে কুলুকুলু তানে বয়ে চলেছে তিস্তা নদী। সীমান্ত পারাপার হতে খুব একটা অসুবিধা হলো না তাঁর। তিনি তিস্তা নদীর ব্রীজের ওপর দিয়ে হেঁটে তিস্তা নদী পার করে নেপালে পৌঁছে গেলেন। দেশের মাটি ছাড়িয়ে তিনি বিদেশে প্রবেশ করলেন। পাহাড়ি পথ দিয়ে তিনি সাইকেলে এগিয়ে চলেছেন। সবুজে সবুজে ভরা নীল পাহাড়ের মাঝখানে পাহাড়ি রাস্তা ভেঙ্গে তিনি আনন্দের সহিত এগিয়ে চললেন। এখনও বহু ক্রোশ অতিক্রম করতে হবে তাঁকে। পথে বিপদ ঘনিয়ে আসার সম্ভাবনাও রয়েছে৷ মৃত্যুও হতে পারে যে-কোনো সময়৷ তবুও তিনি বরাভয় ত্যাগ করে মহাতীর্থের যাত্রার দিকে সম্মুখীন হলেন।

প্রতিবেদন- সুমিত দে  

তথ্যসূত্র- মহাতীর্থের শেষ যাত্রী, বেঙ্গল আর্কাইভ



No comments