Header Ads

ধ্বংসের মুখে ঘোড়ামারা দ্বীপ, লোহাচরার নিয়তি যেন প্রতিনিয়ত তাকে ডাকছে


হুগলি নদীতে মুড়িগঙ্গা নদীর উৎসমুখে অবস্থিত সুন্দরবন অঞ্চলের ঘোড়ামারা দ্বীপ। যার আয়তন ২৫ বর্গকিমি। সাগর ব্লকের ঘোড়ামারা দ্বীপে   আছে প্রায় ১২০০ পরিবারের বাস। আছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভোটার আর জনসংখ্যা ৫ হাজারের মতো৷ এই দ্বীপে আছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, পঞ্চায়েত অফিস, পোস্ট অফিস ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। 


ঘোড়ামারা দ্বীপের মাটি অত্যন্ত উর্বর। চাষের জন্য যথেষ্ট অনুকূল এই দ্বীপ। এখানে প্রচুর পরিমাণে দুধের সর চাল ও মিঠেপাতি পান চাষ হয়। দুধের সর চাল ও মিঠেপাতি পান চাষের জন্য গোটা সুন্দরবনে এই দ্বীপ প্রসিদ্ধ। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ ঘোড়ামারা দ্বীপ নিয়ে সেখানকার মানুষজন কতই না গর্ব করেন। কিন্তু সেই গর্বের দিনগুলো ক্রমশ ম্লান হয়ে আসছে ঘোড়ামারা দ্বীপের মানুষজনের৷ 

বহুকাল আগে ঘোড়ামারা দ্বীপের দক্ষিণে ছিল লোহাচরা নামক আরেকটি দ্বীপ। যে দ্বীপ আজ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দ্বীপটি একটু একটু ভাঙতে ভাঙতে সম্পূর্ণ জলের তলায় চলে যায়। সেই দ্বীপের মানুষের স্মৃতিপট থেকে নানান দুঃখের কথা শোনা যায়৷ এই দ্বীপটি যেখানে অবস্থিত ছিল তার ওপর দিয়ে যারা যাতায়াত করেন তারা একবার হলেও সেই জলকে স্পর্শ করে ভিটেমাটি সম্বল হারানোর যন্ত্রণা অনুভব করেন। 

লোহাচরার নিয়তি এবার ডাকছে ঘোড়ামারা দ্বীপকেও। এই দ্বীপেও আতঙ্কে দিন কাটছে মানুষের। ভাটায় মুড়িগঙ্গার প্রবল স্রোত এবং জোয়ারে সমুদ্রের ঢেউ - এই দুয়ের কবলে দীর্ঘদিন ধরেই ভাঙনকাল চলছে এখানে। ১৯৬৯ সাল থেকেই ভাঙ্গন শুরু হয়েছে ঘোড়ামারা দ্বীপে। প্রথম দিকে সামান্য ভাঙ্গন হয়, বাঁধ দিয়ে তা সমাধান করা গিয়েছিল৷ ২০১০ সালের পর থেকে দ্বীপের উত্তর পূর্বদিক প্রবল ভাঙ্গনের কবলে। বাঁশ-বালির বস্তার বাঁধ দিয়ে আর সামলানো সম্ভব হচ্ছে না ভাঙন। এককালে ঘোড়ামারা দ্বীপের আয়তন ছিল ১৩০ বর্গকিলোমিটার। আজকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে দ্বীপের আয়তন ২৫ বর্গকিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। 

প্রত্যহ যেভাবে দ্বীপের আয়তন কমছে তাতে হয়তো এই দ্বীপও খুব তাড়াতাড়ি বিলীন হয়ে যাবে নদীগর্ভে। দ্বীপের নিত্য ভাঙন যেমন বাসিন্দাদের গৃহহারা করেছে, আর্থিক ভাবে পঙ্গু করে চলেছে প্রতিনিয়ত তেমনই সামাজিক ভারসাম্যে বিশাল সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কারণ, দ্বীপের বাইরের মানুষরা তাঁদের মেয়েদের বিয়ে দিতে চাইছেন না ঘোড়ামারা দ্বীপে। ফলে স্থানীয় ছেলেদের বিয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে দ্বীপের মধ্যেই। এই দ্বীপের বাইরের মানুষজন ভয় পাচ্ছেন, যে বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দেবেন সেই বাড়ি কত দিন টিকবে? ভেঙে যাবে না তো সেই বাড়ি বিয়ের পরের রাতেই?

এই দ্বীপটি রাজ্য তথা দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র হতে পারতো। সুন্দরবনের কোলে থাকা ঘোড়ামারা দ্বীপটি আজ ভাঙনের করাল গ্রাসে বিপন্ন। বিপন্ন তার ভূমি ও মানব জমিন৷ উদাসীন সরকার। অথচ ব্রিটিশ যুগে এই ঘোড়ামারা দ্বীপেই গড়ে উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় টেলিগ্রাফ অফিস৷ ছিল তিনতলা বিশাল বাড়ি, যা আজ শুধু ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতেই একটি ভাড়া ঘরে পোস্ট অফিস চালিয়ে যাচ্ছে ডাকবিভাগ। 

বছরভর পাড় ভাঙছে। বর্ষাকালে টানা তিন মাস বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে পড়ে দ্বীপের একেবারে মাঝখানে। আগে ঢুকে পড়া জল স্লুইস গেট দিয়ে বার করে দেওয়া হতো। স্লুইস গেট ছিল মাইতিপাড়ায় ও চুনপুড়িতে৷ তিন বছর আগে জলের আঁচড়ে স্লুইস গেট-ই ভেঙে গিয়েছে৷ এখন আর জল বার করা যায় না। গিরিপাড়া, রায়পাড়া, বৈষ্ণবপাড়া, পাত্রপাড়া, খাসিমারার বেশির ভাগটা জলের তলায়। চুনপুড়ির পূর্বপাড়া, হাটখোলা এখন জলের তলায় গেল বলে! 

ঘোড়ামারা দ্বীপের মানুষজন ধরেই নিয়েছেন এই দ্বীপ আর খুব বেশিদিন থাকবে না। দ্বীপের বহু মানুষ সমুদ্রগর্ভে ভিটেমাটি হারাতে হারাতে ও নতুন করে ভিটেমাটি গড়তে গড়তে প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে তাদের বারংবার পরাজয় স্বীকার করতে হচ্ছে।  লোহাচরা দ্বীপের মতো ঘোড়ামারা দ্বীপও তলিয়ে যাবে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভূখণ্ড থেকে অসংখ্য দ্বীপ মুছে যাওয়ার মতো ঘোড়ামারা দ্বীপও হয়তো মুছে যাবে। তবুও দ্বীপকে বাঁচানোর  হাজারো চেষ্টা চালাচ্ছেন দ্বীপবাসীরা। সকলের চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ৷ কীভাবে বাঁচবে এই দ্বীপ? বাঁচানোর যেন কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না তারা৷ দ্বীপটি তলিয়ে গেলে হাজার হাজার মানুষ যাবে কোথায়? তখন তো তারাও উদ্বাস্তু হিসেবে পরিণত হবে। তাই এক্ষুণি প্রশাসনকে দ্বীপটি বাঁচানোর সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments