ভারতের হাতি সংরক্ষণের পথিকৃৎ ছিলেন ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী
পূর্ব, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ ভারত হাতি অধ্যুষিত যদিও হাতির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে, হ্রাস পাচ্ছে তাদের বাসস্থান ও খাদ্য দুই-ই; যে কারণে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে হাতির উপদ্রব প্রায়ই দেখা যায়। সাধারণত শীত ও বসন্তে এদের উপদ্রব চোখে পড়ার মতো। পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রাম লাগোয়া ঝাড়খন্ডের দলমা পাহাড়, শিলিগুড়ি, ওড়িশা এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে এদের বাসস্থান। তাই হাতির সাথে মানুষের লড়াই নিত্যদিনের। হাতি ও মানুষ এদের যাতে সহাবস্থান সম্ভব হয় তার জন্য হাতি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
হাতি সংরক্ষণ কীভাবে করা হবে? এজন্য সারা ভারতের ১৬ টি রাজ্য জুড়ে চালু হয় প্রজেক্ট এলিফেন্ট। যার জন্য তৈরি হয় উপদেষ্টা কমিটি। এই কমিটিতে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী।
প্রজেক্ট এলিফ্যান্টের ফলে সারা ভারতে মোট ৩২ টি হাতি সংরক্ষণ কেন্দ্র ঘোষিত হয়। প্রজেক্ট এলিফ্যান্টের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হাতি সংরক্ষণ, বাস্তুতন্ত্র রক্ষা, মানুষের সুরক্ষা ইত্যাদি।
১৯৩১ সালে ময়মনসিংহে জন্ম হয় ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরীর। ময়মনসিংহের হাতিশালা থেকেই তিনি প্রাথমিক ভাবে হাতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর লাভ করেন। এরপর ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন।
অধ্যাপনার ফাঁকে ফাঁকেই তিনি পশ্চিমবাংলা, ওড়িশা, আসাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। নিজের চেষ্টায় হাতিদের আচরণ সম্পর্কে অসীম জ্ঞান আহরণ করেন। ওনার লেখা বিভিন্ন বইগুলি থেকে হাতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। আফ্রিকার উপজাতির লোকেরা কীভাবে হাতির মাংস খেত বা নাগাল্যান্ডের বাজারে এক সময় হাতির মাংস বিক্রি হতো; এসব অনেক অজানা তথ্যও ওনার বইগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ওনার লেখা বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'আ ট্রাঙ্ক ফুল অব টেলস', 'হাতি ও বনজঙ্গলের কথা', 'জঙ্গলগাথা ও রসনাবিলাস', 'হাতি ও বনজঙ্গলের কথা', 'দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান এলিফ্যান্ট বুক', 'হাতির বই', 'বৈঠকী', 'জীবনের ইন্দ্রধনু' ইত্যাদি।
হাতি সম্পর্কে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রিকায় ওনার লেখা প্রবন্ধগুলি বারবার সমাদৃত হয়েছে। হাতি নিয়ে বই লেখার জন্য তিনি পেয়েছেন আনন্দ পুরষ্কার। সারা ভারতের অন্যান্য হাতি বিশারদের কাছেও তিনি বারবার সমাদৃত হয়েছেন। এছাড়াও তিনি ১৯৭৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন অফ নেচার বা আই.ইউ.সি.এন. এর হস্তি বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য হন। ১৯৭৮ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। এক্ষেত্রেও হাতি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গ বন দপ্তরের নজরদারির জন্য ভালো জাতের হাতি প্রয়োজন হলে তিনি বারবার শোনপুরে গিয়ে হাতি কিনে আনার দায়িত্ব পেতেন। ভালো জাতির হাতি বুঝতে ওনার জুড়ি মেলা ভার ছিল। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের হাতিদের আচরণের ব্যাপারে ওনার জ্ঞান বারবার বন দপ্তরকে সাহায্য করেছে। জলদাপাড়া, দলমা, গোরুমারা সব জায়গার হাতি সম্পর্কেই ওনার চেয়ে বেশি আর কেউই জানতেন না।
২০১৯ এ ওনার মৃত্যুতে সারা দেশের হাতি বিশেষজ্ঞ থেকে বন দপ্তরের কর্মী দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। বিজ্ঞান, সাহিত্য, খাদ্যরসিকতার সমাহার ওনার খ্যাতি এনে দেয়। ভারতের হাতি সংরক্ষণের তিনি পথিকৃৎ ছিলেন যা বাঙালির কাছে অত্যন্ত গর্বের।
প্রতিবেদন- অমিত দে
Post a Comment