Header Ads

ভারত ও উগান্ডার স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়েও ইংল্যান্ডের কেমডেনের মেয়র হন এক বাঙালি


রমেন ভট্টাচার্য্য নামটির সাথে হয়তো আপামর বাঙালি খুব একটা পরিচিত নয়। এটা দুর্ভাগ্যের, কারণ বিপ্লবী বাঙালির ইতিহাসে এই ভদ্রলোকটির নাম নিতান্তই মলিন অক্ষরে লেখা থাকার কথা না। রমেন ভট্টাচার্য্যের বর্ণময় জীবন শুরু হয় ছাত্রাবস্থায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এবং শেষ জীবনে ইংল্যান্ডের ক্যামডেনের মেয়র হিসেবে তা পূর্ণতা পায়। ইংল্যান্ডের বাঙালি মেয়র? শুনেই হয়তো অবাক হচ্ছেন। আরও বেশি অবাক করা তাঁর সমগ্র জীবনের ইতিবৃত্ত। আসুন জেনে নিই।


রমেন ভট্টাচার্য্য জন্ম নিয়েছিলেন ১৯২১ সালে কোচবিহারের একটি মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে। বড়ো একটি যৌথ পরিবারের পাঁচ ভাই আর দুই বোনের সংসারে বড়ো ছেলে রমেন। স্বাভাবিক ভাবেই দায়-দায়িত্ব অনেক। বিখ্যাত অনুশীলন সমিতির একটা বড়ো অংশ এই সময় মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে এক নতুন উদ্যমে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন। 

মতাদর্শগত বিবর্তনের মাধ্যমেই তাঁদেরই একটা অংশ রিভলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির (Revolutionary Socialist Party) জন্ম দেন। রমেন ভট্টাচার্য্য ১৯৪০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন যুক্ত হন রিভলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি’র সাথে। ব্রিটিশ রাজ সরকার বিরোধী কার্যকলাপের জন্য এই সময়ে তাঁকে তিনবার জেলও খাটতে হয়েছিল। চতুর্থবার অতি অল্পের জন্য পিসিমার দাক্ষিণ্যে পুলিশের হাত থেকে বেঁচে যান তিনি। তাঁর পিসেমশাই সেই সময় ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করতেন। পুলিশের থেকে বাঁচতে যুবক রমেন আশ্রয় নিলেন পিসিমার বাড়িতেই। সরকারের অনুগত পিসেমশাই ও রমেনকে ধরিয়ে দিতে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু, পিসিমা জেদ ধরলেন, ঘরের ভেতর রাজনীতি ঢুকতে দেবেন না। অগত্যা নিরস্ত হলেন পিসেমশাই। 

১৯৪৫ এ রিভলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির ছাত্র শাখার নেতা নির্বাচিত হন রমেন ভট্টাচার্য্য। ভারতীয় সেনা বাহিনীর বিদ্রোহীদের ফাঁসির হুকুম হলে সহযোদ্ধাদের নিয়ে রমেন ভট্টাচার্য্য এর বিরোধিতা করে ব্যাপক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরবর্তী কালে অবশ্য মহাত্মা গান্ধির ব্যক্তিগত অনুরোধে এই আদেশ রদ হয়ে যায়। তবে সেই সময়ে নেহরু স্বয়ং রমেন ভট্টাচার্য্যকে অনুরোধ করেন আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিতে। রমেন বাবু নেহরুর কথা তো রাখেনই নি, বরং তাঁর সাথে তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময়ে 'দেশভাগ' এর খবর তাঁকে তীব্র আঘাত করে। মর্ম বেদনা নিয়ে মুসলমান ভাই-বোনদের প্রতি সংহতি জানিয়ে সে রাতে নাখোদা মসজিদেই কাটান তিনি। ১৯৪৮ এ পেশায় শিক্ষিকা মীরা নাম্নী এক নারীকে সহধর্মিনী হিসেবে গ্রহণ করেন। আগেই বলেছি, একটি বৃহৎ মধ্যবিত্ত পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন রমেন ভট্টাচার্য্য। সংসারের মুখ চেয়ে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করতেই হল। ইংরেজি এবং অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে একটি চাকরি নিয়ে সস্ত্রীক ১৯৫৫ এ তিনি আফ্রিকা মহাদেশের একটি ছোট্ট দেশ উগান্ডাতে এলেন। সেই চাকরির মাইনেতে উগান্ডাতে নিজেদের খরচ চালিয়েও ভারতে নিজের পরিবারকে স্বাচ্ছন্দে প্রতিপালন করতে থাকেন তিনি। কিন্তু, উগান্ডাতে এসেও তিনি যথারীতি জড়িয়ে পড়লেন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে। আফ্রিকার এই দেশটিতে তখন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। সে দেশের মানুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনিও। তারপর ১৯৬৬ তে ইংল্যান্ডে প্রথমবার পাড়ি। উগান্ডার প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ইংল্যান্ডে আসতে। 

একটি হ্যান্ডব্যাগ কারখানায় ফোরম্যানের চাকরি নিয়ে বসতি গড়ে তোলেন ওয়ান্ডসওয়ার্থে। তখনো বোধহয় কেউ ভাবতে পারে নি, এই সামান্য চাকরি নিয়ে ইংল্যাণ্ডের মাটিতে পা রাখা বাঙালি যুবকটি ইংল্যাণ্ডের রাজনীতিতে এক ভিন্ন হাওয়ার জন্ম দেবেন। এরপর তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বাচ্চাদের পড়ানোর চাকরি নিয়ে ব্যাহাম এবং টাওয়ার হ্যাম্লেটস-এ কয়েক বছর জীবিকা নির্বাহ করেন। এই সময় 'ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ টিচার্স’ (National Union of Teachers) এর রাজনীতিতে যোগ দেন। একইসাথে বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন। সেই সময়ে ব্রিটেনে সংখ্যাগুরুবাদের রাজনীতি চলছে। 'কিপ ব্রিটেন হোয়াইট' [‘KBW’ - Keep Britain White] স্লোগানে বৈষম্য বাড়তে থাকে। প্রতিবাদের কন্ঠ হয়ে ওঠেন রমেন ভট্টাচার্য্য। বিভিন্ন অবৃটিশ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একযোগে সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলা তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব ছিল। 

১৯৮৪ সাথে বেলসাইজ পার্ক এলাকায় এসে বসবাস শুরু করেন এবং যুক্ত হন লেবার পার্টির সাথে। ১৯৮৬ সালে চাকরিজীবন থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে গভীর ভাবে মনোনিবেশ করেন। ১৯৮৮ তে প্রথম কাউন্সিলার হিসেবে নির্বাচিত হন। তারপর ১৯৯২ তে ক্যামডেনের ডেপুটি মেয়র এবং ১৯৯৩ এ মেয়র পদে অভিষিক্ত হন। ৮০ বছর বয়সে তিনি আরেকবার গ্রেফতার হন টনি ব্লেয়ারের পুলিশের হাতে। একটি সাংবাদিক সম্মেলনে টনি ব্লেয়ারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি কিছু কাগজ পত্র নিয়ে ব্লেয়ারের বিরুদ্ধেই তথ্য প্রমাণ সহযোগে তোপ দাগেন। এই অপরাধে সন্ত্রাসবাদী দাগিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হলে, তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল, "যুবাবস্থায় আমাকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। আজ এই বয়সেও একই আখ্যা পেলাম। আমি খুশি এটা ভেবে যে আমি আমার রাস্তায় অবিচলিত আছি এবং আমার দক্ষতা বিন্দুমাত্র কমেনি"। 

স্বভাব বিদ্রোহী এই মানুষটি কিন্তু খুব সুন্দর রান্নাও করতে পারতেন। প্রতিবেশীদের 'মাছের মুড়ো দিয়ে ডাল' রেঁধে খাইয়েও তাদের হৃদয় জিতে নিয়েছিলেন। নিজের আদর্শ এবং হাসিখুশি স্বভাবের জন্যে প্রতিবেশীদের প্রিয় ছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে বড়ো ছেলে ভাস্কর মারা যাওয়ার পর সেই আঘাত সামলাতে পারেন নি। ডায়াবেটিসে ভুগতেন, তার প্রকোপ বেড়ে গেল কয়েক গুণ। তিনি সাঁতার কাটতে ভালোবাসতেন কিন্তু পা অকেজো হয়ে যাওয়াতে তাও পারতেন না এর কিছু পরে। ২০১২ তে হাঁটুর হাড় ভেঙে সমস্যা গুরুতর হয়। ওষুধ, খাওয়া-দাওয়া সব কিছুতেই অনীহা তৈরি হয়েছিল। অবশেষে, ২০১৩ সালের ২৭শে এপ্রিল ৯১ বছর বয়সে তার দেহাবসান হয়। সারা জীবন নিজের ইচ্ছেয় চলা এই বিদ্রোহী মানুষটার জীবনাবসান ও যেন খানিক নিজের ইচ্ছেতে। ২০২১ এ মানুষটি শতবর্ষে পদার্পন করলেন।

প্রতিবেদন- অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায় 


No comments