Header Ads

প্রেসার কুকারের পূর্বসূরি ইকমিক কুকারের আবিষ্কর্তা ছিলেন এক বাঙালি


উনবিংশ শতকে অত্যন্ত আনুষঙ্গিক হিসেবে রান্নাঘরের সাথে থাকতো একটি জরুরী বিভাগ- জ্বালানী কাঠ, কয়লা, গুল ও ঘুঁটে। হুগলীর গুপ্তিপাড়ার মল্লিকবাড়িতেও ওভাবে প্রচলিত পদ্ধতিতে রান্না হতো। পরিবর্তন একটা এলো অবশ্য ঐ বাড়ির রাধাগোবিন্দ মল্লিকের পুত্র ইন্দুমাধব মল্লিকের হাত ধরে। 


ইন্দুমাধব মল্লিক একবার পুরী ভ্রমণে গিয়েছিলেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দির দর্শনের সময় তাঁর চোখ বিশেষভাবে আটকে পড়ে মন্দির চত্বরে অবস্থিত জগন্নাথদেবের রান্নাঘরের দিকে। যা দেখে একটা ভাবনা তাঁর মাথাতে ঘুরপাক খেতে থাকে। দরজার ফাঁক দিয়ে তিনি দেখেন জ্বলন্ত উনুনে প্রথমে একটি বড় হাঁড়ি, তারপর ক্রমশ ছোট থেকে আরো ছোট, এইভাবে পর পর ছ'টা হাঁড়ি বসানো। প্রতিটি হাঁড়িতেই খাবার রয়েছে। এই ভাবেই হাজার হাজার লোকের জন্য ভোগ রান্না হচ্ছে। তিনি চিন্তা করতে থাকেন যে এভাবে রান্না হলে অনেক পরিশ্রম বাঁচবে। সময়ও বাঁচবে। জ্বালানি সাশ্রয় হবে এবং খাদ্যগুণ বজায় রাখাও সম্ভব হবে। 

শুরু হল তাঁর ভাবনাচিন্তা। কয়েক মাসের পরিশ্রমে তিনি বানিয়ে ফেললেন 'ইকমিক কুকার'। বলা ভালো, ইকমিক কুকার হলে আজকের প্রেসার কুকারের পূর্বসূরী। ইকমিক কুকার নামটির উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে তা আজও অজানা। আন্দাজ করা হয় ইকনমিক কুকারের অপভ্রংশ থেকে হয়তো। জানা যায়, আবিষ্কর্তার নামে কেউ কেউ একে মল্লিক কুকারও বলতেন। ভ্রমণপিপাসু খাদ্যরসিক বাঙালিরা নাকি সেযুগে ট্রেনে করে ভ্রমণের সময়েও এটি সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আজও নাকি কলকাতার বউবাজারে দেখা মেলে ইকমিক কুকারের।  

১৯১০ সাল, ভারতের রাজধানী তখন কলকাতা। ইন্দুমাধব মল্লিকের সৌজন্যে সেই শহরেই বাণিজ্যিক ভাবে শুরু হলো ইকমিক কুকারের উৎপাদন। এতে থাকতো একটা বড় সিলিন্ডার, তার মধ্যে টিফিন ক্যারিয়ার। তার মধ্যে থাকতো একাধিক বাটি। প্রত্যেক বাটিতে ভাত ডাল সব্জী আলাদা করে রাখা হতো। সিলিন্ডারের মধ্যে অল্প জল দিয়ে আগুনের ওপর বসানো হতো। আগুনে জল বাষ্প হয়ে সব খাবার রান্না হয়ে যেত। এতে খাবার পুড়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না।  

যদিও আজকের প্রজন্মের কাছে অদেখা ইকমিক কুকার। অজানা তার আবিষ্কারকও। তবুও এই আবিষ্কারের দ্বারা সেযুগের রান্নাঘরে এসেছিল আধুনিকতার চমক। 

ইন্দুমাধব মল্লিক সম্পর্কে ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকের দাদু। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬৯ সালের ৪ ঠা ডিসেম্বর হুগলির গুপ্তিপাড়ায়। মায়ের নাম শ্রীমতী কালীকামিনী দেবী। পিতা শ্রী রাধাগোবিন্দ মল্লিক। ৭ বছর বয়সে ইন্দুমাধব মল্লিক কলকাতার হেয়ার স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানে পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এবং তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এফ.এ. পড়লেন দর্শন নিয়ে।  ১৮৯১ সালে তিনি এম.এ. পাশ করলেন। এরপর তিনি ঠিক করলেন আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করবেন। পদার্থ বিদ্যা নিয়ে আরেকটা ডিগ্ৰি অর্জন করলেন তিনি । তিনি ডাক্তারি আর আইন নিয়েও পড়াশোনা করেন। ১৮৯৮ সালে ডাক্তারি পাস করে পেয়েছিলেন "লাইসেন্স ইন মেডিসিন এন্ড সার্জারি"। অবসর সময় পেলে রোগীদের দেখতেন তিনি। 

সমাজের স্বাস্থ্যের হাল ফেরাতেও তিনি চেষ্টা করেন। দেশে যাতে অটোভ্যাকসিন পদ্ধতি চালু হয় সেই ব্যাপারেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। মূল্যবান পাণ্ডুলিপি তো সংগ্রহ করতেনই। এছাড়াও তিনি জাতীয়তাবাদী  মনোভাবাপন্নও ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। দেওঘরে বোমা পরীক্ষা করার সময় উল্লাসকর দত্ত গুরুতর আহত হলে এই ইন্দুমাধব মল্লিকই গোপনে তাঁকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন। 

আপামর বাঙালির কাছে আজ আত্মবিস্তৃত একটি নাম হলো ইন্দুমাধব মল্লিক। আজকের যুগে কেউই ইকমিক কুকারের সাথে সেভাবে পরিচিত নন৷ আজকাল সচরাচর পাওয়া যায় না ইকমিক কুকার কিন্তু কলেজ স্ট্রিটের কিছু দোকানে অর্ডার দিলে তারা বানিয়ে দিতে পারে ইকমিক কুকার এবং পুরানো ইকমিক কুকার তারা সারাতেও পারে৷ বাংলা ছাড়াও ভারতবর্ষের অনেক পুরানো বাড়িতে পাওয়া যেতে পারে ইকমিক কুকার।  

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments