Header Ads

কোভিডে চিকিৎসার জগতে আরেক ছন্দপতন : প্রয়াত হলেন ডা. স্মরজিৎ জানা




১৯৯২ সাল। কলকাতার খিদিরপুরের ভাইরাস ঘটিত একটি রোগের খবরে শোরগোল পড়ে গেল চারিদিকে। তা সেই ভাইরাসটি কি? সেবার কলকাতার খিদিরপুর অঞ্চলের একজন এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হলেন। এইচআইভি যার পুরো নাম 'হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস' বাংলায় যাকে বলা হয় 'মানব প্রতিরক্ষা অভাবসৃষ্টিকারী ভাইরাস'। এর সংক্রমণের ফলে মানবদেহে এইডস রোগের সৃষ্টি হয়। তা, সেই শোরগোলের ফলে রেডিও, টেলিভিশন, খবরের কাগজ (তখন অবশ্য ইন্টারনেটের চল ছিল না আর তাই ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার সহ ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইট তো কোন ছাড়) সহ বিভিন্ন মিডিয়াতে শুরু হলো এইডস নিয়ে সচেতনমূলক প্রচার। তবুও এসব প্রচারে ঢক্কানিনাদে চাপা পড়ে গিয়েছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে যৌনকর্মীদের জন্য আলাদা করে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারটা। অথচ, এইডস হল যৌন-সংক্রমিত রোগ আর তাই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার বা এইচআইভির মতো মারণ ভাইরাসের  সংক্রমণের সম্ভাবনা সবথেকে বেশি ওই  যৌনকর্মীদের। তাই, সংক্রমনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং উক্ত ভাইরাস ও রোগ সম্পর্কে সচেতনতার পাঠ ও প্রচার বাড়াতে মাঠে নামলেন এক বাঙালি চিকিৎসক, যিনি নিজ-উদ্যোগেই শুরু করলেন ওই সচেতনতার প্রচার। এই চিকিৎসকের নাম ডা. স্মরজিৎ জানা। 

কিন্তু প্রচার ও সচেতনতার জন‍্য যে বিপুল সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী দরকার তা কই? ডা. জানা এক্ষেত্রে কাজে লাগালেন যৌনকর্মীদেরই। খিদিরপুরের বলাকা ক্লাবের মতো একেবারে ছোট্ট ক্লাবঘরটিতে গড়ে তুললেন অফিস। আর এভাবেই এইডস নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি তা প্রতিকার এবং সে সম্পর্কে সচেতনতা প্রচারের কাজে নেমেছিলেন ডা. জানা। যে পল্লীকে ভদ্রসমাজ বাঁকা চোখে দেখে, সেই নিষিদ্ধপল্লীতেই একাধিক উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এই ডাক্তারবাবু। তিনি গড়ে তুলেছিলেন 'দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি'। ১৯৭৮  সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস পাস করেন তিনি। এরপর স্নাতকোত্তর বা এমডি করেন কলকাতার 'স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন' থেকে। এমডি পাশ করার পর তিনি বিদেশে পাড়ি দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের 'জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়' থেকে অতিমারী এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি চাইলে বিদেশেই বিলাসবহুল জীবন কাটাতে পারতেন, কিন্তু তা না করে তিনি  চলে এলেন এই কলকাতায়– সাধারণ মানুষের, প্রান্তিক মানুষের ডাক্তার রূপে। তিনি যৌনকর্মীদের হয়ে উঠেছিলেন এক দরদী অভিবাবক। শুধু চিকিৎসা নয়, সমাজের পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের অধিকারের ব্যাপারে একাধিক আন্দোলনের পথিকৃৎ এই ডাক্তারবাবু। 

বেশ কিছুদিন আগে কোভিড রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ডা. জানা। বেশ আশঙ্কাজনক অবস্থাতেই তাঁকে ভর্তি করানো হয়েছিল কলকাতা শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু, খুব দুঃখের বিষয় এই যে হাজার চেষ্টাতেও বাঁচানো গেল না স্বনামধন্য, মানবদরদী এই ডাক্তারবাবুকে। গত ৮ই মে, ২০২১ সকাল ১১টা নাগাদ আমাদের ছেড়ে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন ডাক্তারবাবু। এইচআইভি ভাইরাসকে আটকানোর এই যোদ্ধা চিকিৎসকের প্রাণ কেড়ে নিল আরেক মারণ ভাইরাস–করোনাভাইরাস। মানবশত্রু ভাইরাস কেড়ে নিল এই মানববন্ধুকে। বিশিষ্ট সমাজকর্মী, মহামারী বিশেষজ্ঞ, যৌনকর্মীদের এক দরদী অভিভাবক, রাজ্যের যৌনকর্মীদের কল্যাণের স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত 'দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি'-র প্রতিষ্ঠাতা, মানবকল্যাণকর এই চিকিৎসককে কোভিড-১৯ মহামারী রোগের জন্যে আমাদের হারাতে হল। চিকিৎসাক্ষেত্রে তথা সামাজিক ক্ষেত্রে ঘটল এক নিবিড় ছন্দপতন। 

প্রতিবেদন- ইন্দ্রনীল মজুমদার


No comments