শৈশবের স্মৃতিচারণে ঋতুপর্ণ ঘোষের জবানবন্দি
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ নিখাদ বাঙালিয়ানাতে বিশ্বাস করতেন। তাঁর শৈশবের কাহিনী তিনি নিজের হাতে লিখে গেছেন, যা পড়লে আমাদেরও বারংবার ছেলেবেলার দিনগুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করবে। তিনি এতো বড়ো মাপের পরিচালক হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজেকে নিয়ে কখনো গর্ব করতেন না। তাঁর মনের মধ্যে কোথাও না কোথাও একটা শূন্যতা কাজ করতো। ঋতুপর্ণ ঘোষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে তিনি যে বিশেষ লেখাটি লিখেছিলেন সেটা তুলে ধরলাম যাতে সকল বাঙালির স্মরণে এই লেখাটা ফিরে ফিরে আসে। বাঙালির অস্মিতাকে কিছুটা হলেও নাড়িয়ে দেয় এই লেখাটি।
তিনি লিখছেন--------
"প্রথম কথা বলতে কে শিখিয়েছিল জানি না। কালোর ওপর লাল পাখির নকশা-করা একটা বেডকভার ছিল বাড়িতে। সেটা দেখে প্রথম পাখি চিনতে শিখি। তখন পাখি বলতে পারতাম না। বলতাম 'কাপি'।
প্রথম গান শিখিয়েছিল মাসিমণি। 'আলো আমার আলো ওগো'। চান করানোর আগে তেল মাখাতে মাখাতে।
প্রথম 'পথের পাঁচালী' কিনে দিয়েছিল পিসিমণি। পিসিমণির তখনও বিয়ে হয়নি। বাবার সব থেকে ছোট বোন। শ্যামলা রং, মোটা একটা বিনুনি। অপু দুর্গার গল্প পড়ে মনে হয়েছিল, পিসিমণি আমার দিদি হলে বেশ হত !
প্রথম ফাউন্টেন পেনে লিখতে শিখিয়েছিল বাবা। শিখিয়েছিল কেমন করে মহাভারত পড়তে হয়। রাজশেখর বসুর মহাভারত। সন্ধ্যেবেলা হোমওয়ার্ক সেরে আমরা তিনজনে বসতাম। বাবা পড়ত। আমি আর ঠাকুমা শুনতাম। বাবা শিখিয়েছিল কেমন করে জাদুঘর দেখতে হয়। শিখিয়েছিল উত্তর ভারতের মন্দিরের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের তফাৎ কী। শিখিয়েছিল U ছাড়া শুধু Q দিয়ে ইংরেজি বানান হয় না। শিখিয়েছিল ইংরেজি হরফের আসল নাম রোমান।
মা গান গাইতে পারত না। তাই সঞ্চয়িতা পড়ে ঘুম পাড়াত আমাকে। সেই আমার রবীন্দ্রনাথে হাতেখড়ি। মা যে আজ ওতে ছবি-আঁকিয়ে, সে-কথা মনেই থাকত না। একদিন সন্ধ্যেবেলা বিছানায় বসে হোমওয়ার্ক করছি, আর সামনে বসে আমারই একটা পুরোনো খাতার পিছনের পাতায় পেনসিল দিয়ে আঁকিবুকি কাটছে মা। ঝুঁকে পড়ে দেখি, মা স্কেচ করছে। বিছানার ওপাশের টেবিল ফ্যানটার স্কেচ। সেই দিনই শিখলাম তিন ডানাওয়ালা ফ্যানটা আসলে একটা তিন পাপড়ি মেলা ফুল।
ঠাকুমা শিখিয়েছিল কাঁচালঙ্কার রং সবুজ আর শুকনো লঙ্কা নাকি লাল। শিখিয়েছিল প্রথম পাতে তেতো খাওয়ার পর জল খেলে মিষ্টি লাগে। শিখিয়েছিল গরমকালের কুঁজো আর শীতকালের কাঁথা। পঞ্চুপিসি শিখিয়েছিল বেস্পতিবারের আরেক নাম বিষ্যুদবার। আর সন্ধ্যেবেলার পর সাপের নাম লতা। চিঙ্কু -- আমার ভাই -- প্রথম শেখালো বড়ো হয়ে যাওয়া। প্রথম মিথ্যে কথা কে শিখিয়েছিল মনে নেই। কে শিখিয়েছিল আসলে কী করে বাচ্চা হয় ভুলে গিয়েছি। এক এক ছেড়ে চলে গিয়েছে যে মানুষগুলো, তারা শিখিয়ে গিয়েছিল, শুধু আরও কষ্ট পাবো বলে এই বেঁচে থাকাটা কতো সুন্দর !
বাংলা ভাষা নিয়ে অহংকার করতে শিখিয়েছে রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, শিবরাম, মুজতবা আলী। সত্যজিৎ প্রথম শিখিয়েছে ক্যামেরা দিয়ে গল্প বলা যায়। চাইলে কবিতাও।
মা চলে গিয়ে দুটো জিনিস শিখিয়ে দিয়ে গেল। মা-রা আসলে অমর আর মা ছাড়া বাবারা বড়ো অসহায়...
কথা হচ্ছে, এতো কিছু শিখেও এমন একটা আস্ত অপোগন্ড তৈরি হলাম কী করে ?"
প্রতিবেদন- নিজস্ব সংবাদদাতা
Post a Comment