Header Ads

ফিরে দেখা কথা বলা পুতুল মাইকেল ও তার স্রষ্টা প্রবীরকুমার দাসকে

বঙ্গজীবনের সাথে জড়িত রয়েছে দূরদর্শনের কিছু অনুষ্ঠান। সাতের দশকের শেষ থেকে আটের দশকের শুরু, এই সময়টাতে সাদা কালো টিভিতে মনোরঞ্জন জমে উঠতো বেশিরভাগ বাড়িতে। অ্যান্টেনা ও ডিসের মাধ্যমে চ্যানেল ধরতো টিভিতে। চ্যানেল বলতে হাতে গোনা কয়েকটি চ্যানেল। রকমারি অনুষ্ঠান দেখার জন্য অন্যতম চ্যানেল ছিল বাংলা দূরদর্শন বা ডিডি বাংলা। ছোটো-বড়ো সবার জন্য ছিল অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি। 


মধ্যবিত্ত হোক বা নিম্নবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত সব বাড়ির ছেলেমেয়েরা তাদের শৈশব কাটিয়েছে ডিডি বাংলার সাথে। কথাবলা এক পুতুলকে নিয়ে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান সবার নজর কেড়েছিল। যে অনুষ্ঠানের নাম ছিল "চিচিং ফাঁক"। সেই সময়ে যাদের বাড়িতে টিভি ছিল শুধু তারাই জানেন যে 'চিচিং ফাঁক' অনুষ্ঠানটি ছোটো-বড়ো সব বয়সের মানুষকে ঠিক কতটা আকর্ষণ করতো। 

"চিচিং ফাঁকে"র মধ্যে যে অনুষ্ঠান সবার প্রিয় ছিল তা হলো 'মাইকেলের আসর'। প্রবীরকুমার দাস আর তার সাধের কথাবলা পুতুল মাইকেল ছিল অনুষ্ঠানের মূল উপকরণ। মোটা কালো ফ্রেমবাঁধানো চশমা পরিহিত, চওড়া গোঁফওয়ালা এক ছিপছিপে মানুষের কোলে বসে মাইকেল বকবক করে যেত। মাইকেলকে দেখলে মনে হতো যেন সেই ভদ্রলোকের ভাইপো।     

১৯৭৫ সালের ৯ ই আগস্ট শুরু হয় 'মাইকেলের আসর'। যে অনুষ্ঠানটি একটানা চলছিল ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। চলতি বছরে ৪৫ বছর অতিক্রম করলো এই অনুষ্ঠান। টিভির পর্দায় দেখা মেলে এক কথাবলা পুতুলের যে পুতুলটি দিব্যি খুদেদের সাথে গল্প জুড়ে দিতো। ঘাড় নাড়িয়ে মাইকেল প্রবীরবাবুকে কত যে প্রশ্ন করে যেত তার ইয়ত্তা নেই। দর্শকের দিকে মুখ করে মাইকেল এমনভাবে কথা বলতো যে মুখ ফসকে হাসি বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। সেদিনের এতো সুন্দর অনুষ্ঠান টিভিতে আজ আর হয়না বললেই চলে। 

মাইকেল ও অন্য দুই কথা বলা পুতুলের সঙ্গে প্রবীরবাবুর বন্ধুরা মাইকেলকে বিস্কুট, চকোলেট, হাতে আঁকা ছবি দিতো। মাইকেলকে দেখে বোঝার উপায় ছিলনা যে ওটা নিছকই একটা পুতুল। একটা পুতুলের মধ্যে এমন কিই বা আছে যে মানুষের মতো কথা বলতে পারে? নাকি অন্য কোনো প্রযুক্তির সাহায্যে মাইকেল আপনমনে কথা বলে?      

পুতুলের কথা বলার পদ্ধতির ব্যাপারটা তৈরি করা হয় স্বরক্ষেপণের সাহায্যে যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ভেন্ট্রিলোকুইজম। তিনটি মঙ্গলবার অন্তর সন্ধ্যা সাড়ে ছটা থেকে সাতটা পর্যন্ত টানা চৌদ্দ বছর ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত লাইভ অনুষ্ঠান করতেন প্রবীরকুমার দাস। অসংখ্য দর্শকদের অনুরোধে প্রতি সপ্তাহে এই অনুষ্ঠানটি করতে বাধ্য হন প্রবীরবাবু।   

মাইকেলকে ঘিরে প্রতিটি দর্শকদের ভালোবাসা জমে উঠেছিল। বাইকে মাইকেলকে সিটের সামনে বসিয়ে দূরদর্শন ভবনে লাইভ অনুষ্ঠানের জন্য পাড়ি দিতেন প্রবীরবাবু। মাইকেলকে দেখার জন্য রাস্তার দুপাশে লোকেদের ভিড় জমে উঠতো। একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল প্রবীরকুমারের সাথে। তিনি মাইকেলকে একটা বড় ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলেন, যা দেখে বাচ্চারা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। বাচ্চারা ভাবছিল ব্যাগের মধ্যে মাইকেলকে ঢোকালে যদি দমবন্ধ হয়ে মাইকেল মারা যায় তখন কী হবে? প্রবীরবাবু বাচ্চাদের কান্নাকাটি করা দেখে মাইকেলকে ব্যাগ থেকে বের করে ফেলেন।                   
       
বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায় থেকে মহানায়ক উত্তম কুমার, সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা পাহাড়ি সান্যাল সকলের কাছেই মাইকেল নামের পুতুলটি জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। সত্যজিৎ রায় 'ভূতো' নামের একটি গল্পের শ্যুটিং এর জন্য মাইকেলকে পছন্দ করেছিলেন। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments