Header Ads

ইতিহাসের পাতার আড়ালে থেকে যাওয়া বাঙালি ভাষাযোদ্ধা 'মানভূম জননী' লাবণ্য প্রভা ঘোষ


পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটা দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন হলো মানভূম ভাষা আন্দোলন। যে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯১২ সালে। গোটা মানভূম জুড়ে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলন। ১৯৫৬ সালের আগে পুরুলিয়া ছিল বিহারের অন্তর্গত। কিন্তু পুরুলিয়ার বেশিরভাগ মানুষ ছিল বাঙালি, তাদের ওপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে বাঙালি জনসমাজ৷ 


মানভূম ভাষা আন্দোলনে বহু বাঙালি পুরুষ ও নারী অংশ নিয়েছিল৷ মানভূম ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ছিলেন লাবণ্যপ্রভা ঘোষ৷ যাকে গোটা পুরুলিয়া জানে 'মানভূম জননী' নামে। ভাষা আন্দোলনের অবদানের জন্য ভাষাশহীদ স্মারক সমিতির পক্ষ থেকে ২০০৩ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে সমাদৃত করেছিলেন৷ 

কোনো স্মরণীয় মূর্তি বা ফলক বাংলার বিশিষ্ট মহিলা বিপ্লবী লাবণ্য প্রভা ঘোষের অসাধারণ জীবনকে চিহ্নিত করে না৷ বাঙালি পুরুষ ও নারী সহ সকল বিপ্লবীদের অনেকেই স্বাধীনতার পরেও দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে মারা গিয়েছিলেন। বহু মানুষ আজকে ভুলতে বসেছে স্বাধীনতার যুদ্ধের লড়াকু সৈনিকদের কথা৷ লাবণ্য প্রভা ঘোষও তাদের মধ্যে অন্যতম৷ তাঁর ১০৬ বছরের জীবনে তাকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছে। বহু অপমানের বেড়া ভেঙে তিনি এগিয়ে যেতেন৷ বাংলা ভাষা তার জন্য যথেষ্ট গর্বিত৷ তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী বীরাঙ্গনা ভাষাযোদ্ধা। 

১৮৯৭ সালের ১৪ ই আগস্ট পুরুলিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন লাবণ্য প্রভা ঘোষ৷ তিনি কখনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পাননি। পরিবর্তে তার নিজের বাড়িতে বাবার কাছে পড়াশোনা শেখেন৷ তাঁর পিতা ছিলেন ঋষি নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্ত। যিনি ছিলেন পুরুলিয়া জেলা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মাত্র এগারো বছর বয়সে স্বাধীনতা সংগ্রামী অতুল চন্দ্র ঘোষের সাথে তাঁর বিবাহ হয়।

লাবণ্য প্রভা ঘোষ পুরুলিয়ার  প্রথম মহিলা এমএলএ হিসেবে 'লোক সেবক সংঘে'র হয়ে নির্বাচিত হন। তিনি মানভূম অঞ্চলের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র 'শিল্পাশ্রমে'র সক্রিয় সদস্য ছিলেন৷ এই 'শিল্পাশ্রম' এ চিত্তরঞ্জন দাশ থেকে শুরু করে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী মিলিত হতেন। তিনি পুরুলিয়ার মাটিতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন৷ তিনি ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহ, ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও ১৯৪৫ সালে পতাকা সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য একাধিকবার কারারুদ্ধ হন৷ 

তাঁর বাবা নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্ত স্বাধীনতার সংগ্রামের পাশাপাশি একটি দ্বি-সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা 'মুক্তি' প্রতিষ্ঠা করেন৷ এই পত্রিকা ছিল মানভূম থেকে প্রকাশিত একটি প্রভাবশালী বিপ্লবী প্রকাশনা। যা স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং পরবর্তীকালে ১৯৪০ ও ১৯৫০ এর দশকে ভাষা আন্দোলনের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই পত্রিকাতে নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত কিছুদিন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর এই পত্রিকার দায়িত্ব দেন জামাতা অতুল চন্দ্র ঘোষকে। এই পত্রিকার সূত্র ধরে লাবণ্য প্রভা ঘোষ লেখালেখি শুরু করেন। অতুল চন্দ্র ঘোষের মৃত্যুর পর তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক হন৷ 

অবশেষে এলো ১৯৪৭ সাল। সহস্র প্রাণ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করলো ভারতবর্ষ৷ শত শত বিপ্লবীর মু্ক্তি সংগ্রাম সফল হলো। কিন্তু স্বাধীন হতে পারলো না পুরুলিয়া। সেখানকার মানুষদের ওপর বিহারের মানুষ বাঙালিদের ওপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করে। বাঙালির ওপর হিন্দি ভাষার বোঝা চাপিয়ে বাঙালিকে কোণঠাসা করে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়। বাংলা মিডিয়াম বন্ধ করে পুরুলিয়ার স্কুলগুলোতে হিন্দিতে শিক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। যা বাঙালিকে প্রচণ্ড সমস্যায় ফেলে দেয়। বাঙালিরা বাংলা ভাষার অধিকারের দাবীতে গণআন্দোলনের ডাক দেয়। 

ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর লাবণ্য প্রভা ঘোষ বাংলা ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। মানভূম ভাষা আন্দোলনের জন্য প্রায় তিনবার গ্রেপ্তার হন তিনি৷ ১৯৫৬ সালের ২০ শে এপ্রিল পাকবিড়া গ্রাম থেকে কলকাতা পর্যন্ত যে দীর্ঘ পদযাত্রার আয়োজন করা হয়, তাতে তিনি পা মিলিয়েছিলেন৷ ৭ ই মে কলকাতা পৌঁছানোর পর তিনি গ্রেপ্তার হন৷ সবশেষে বাঙালির অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের ফলাফল হিসেবে ১৯৫৬ সালের ১ লা নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের সাথে পুরুলিয়াকে সংযুক্ত করা হয়। লাবণ্য প্রভা ঘোষের মতো ভাষাযোদ্ধাদের আন্দোলন সেদিন সফল হয়েছিল। আজকেও যখন হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ বাংলার বুকে ভয়ংকর ভাবে থাবা বসাচ্ছে তখন প্রতিটি বাঙালিকে স্মরণ করতে হবে লাবণ্য প্রভা ঘোষের মতো ভাষাযোদ্ধাদের৷


তথ্যসূত্র- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, টেলিগ্রাফ

No comments