Header Ads

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই দশকের সেরা বাংলা ছবি 'ফাগুন হাওয়ায়'


বাংলাদেশের জনপ্রিয় পরিচালক তৌকির আহমেদের ছবি 'ফাগুন হাওয়ায়'। ৫২ এর বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছে ছবিটি। সহজে বলতে গেলে ভাষা, সংস্কৃতি ও শেকড় খোঁজার গল্প হলো এই ছবি। 


ছবিতে আমরা দেখতে পাই জামশেদ খান নামের একজন উর্দুভাষী পাকিস্তানি পুলিশ অফিসার। যিনি বাঙালিদের মোটেও পছন্দ করেন না। বাঙালিরা বাংলা বললে তিনি রেগে যান। বাঙালিকে হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করে বাঙালি মুসলিমদের উর্দু শিখতে বাধ্য করতে থাকেন তিনি। তার পানিশমেন্ট পোস্টিং হয়েছে 'চন্দ্রপুর' নামে খুলনার এক মফস্বল শহরে। যেই লঞ্চে করে তিনি ঢাকা থেকে খুলনায় যাচ্ছিলেন সেই লঞ্চেই উঠেছে একই গন্তব্যের যাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাসির ও ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রী দীপ্তি। একজন বাউল বাংলায় গান গাইছে দেখে তাঁর গায়ে হাত তুলে বসেন জামশেদ। সেখানেই তৎক্ষণাৎ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান নাসির ও দীপ্তি।  

নাসির পড়াশোনার পাশাপাশি একটি নাটক দলে কাজ করেন। যে নাট্যদলে দীপ্তিও অভিনয় করার জন্য যুক্ত হন৷ এই নাট্যদলে কাজ করবার সুবাদে দীপ্তি ও নাসির ক্রমশ একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। একসময় তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কও তৈরি হয়। নাসির ও দীপ্তি বাংলা ভাষাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন।   

চন্দ্রপুর এলাকার লোকজনের কাছে জামশেদ একাকী ত্রাস হয়ে হাজির হন। পূর্ববঙ্গের যেসব লোকেরা পাকিস্তানি সেনার দলে কাজ করতেন জামশেদ তাদের বাংলা বলতে নিষেধ করে দেন। তাদের তিনি উর্দু শেখার ওপর জোর দিতে বলেন। জামশেদ বাংলাকে হিন্দুয়ানী ভাষা দাবি করে গ্রাম থেকে মুছে ফেলার প্রত্যয় নেন। এমতাবস্থায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর জামশেদ গ্রামের লোকেদের জোর করে একজন মাওলানা ডেকে উর্দু ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। অপরদিকে এলাকার নাট্যদল এরূপ শোষণের প্রতিবাদ হিসেবে নীলদর্পণ মঞ্চায়নের প্রস্তুতি নেয়৷ এভাবেই এগোতে থাকে ছবির চিত্রনাট্য। 

ছবিতে বেশ কিছু মজার দৃশ্যও আছে তার মধ্যে যে দৃশ্যটা না লিখলেই নয় তা হলো জামশেদ খান বাঙালিদের মাওলানা দিয়ে উর্দুর পাঠ শেখাচ্ছেন সেই সময় একটা বউ কথা কও পাখি 'বউ কথা কও' বলে ডাকাডাকি শুরু করে। তখন জামশেদ পাখিটির দিকে গুলি ছুঁড়ে দেন। যদিও সেই গুলি পাখির দেহ ভেদ করতে পারলো না। তিনি তার অন্যান্য পুলিশ কর্মীদের পাখিটিকে ধরে আনার নির্দেশ দেন, সেইমতো পাখিটিকে খাঁচা বন্দী করে নিয়ে আনেন পুলিশ কর্মীরা। এরপর তিনি পাখিটিকে শেখানোর চেষ্টা করে উর্দুতে যে 'বিবি বাত কারো'। কিন্তু তিনি এটা জানেন না যে বউ কথা কও কথা বলতে না পারা একটি পাখি। তার ডাকই আসলে বউ কথা কও।  

ছবির গল্পে বড়ো করে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার লড়াইকে। বাংলা ভাষা নিয়ে উর্দু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ছবির গল্পে উঠে এসেছে দীনবন্ধু মিত্রের লেখা 'নীলদর্পণ' নাটক। আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক হিসেবে হাতিয়ার করা হয়েছে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতাকে। সত্যিই অনবদ্য এক ছবি হলো 'ফাগুন হাওয়ায়'।

এ ছবি আমাদের একটাই শিক্ষা দেয় যে ভাষা কখনো ধর্মভিত্তিক হয়না। ভাষার কোনো ধর্ম হয়না। যাদের মাতৃভাষা বাংলা তারা জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই বাঙালি। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে হিন্দু বাঙালি ও মুসলিম বাঙালি সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছিলেন বলেই বাংলা ভাষাকে বাঁচানো ওপার বাংলাতে সম্ভব হয়েছিল। আর রাজাকাররা হাজার চেষ্টা করলেও কোনোদিনই বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করতে পারবে না। 

দুই বাংলার সকল বাঙালির এ ছবিটি দেখার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারাও যে ছবি নির্মাণে কোনো অংশে কম নন, তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই ছবি। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments