বর্ণপরিচয়ের জন্মস্থান দেব সাহিত্য কুটীরের 'হেরিটেজ' তকমা পাওয়ার এক বছর
বাংলার প্রকাশনা ও সাহিত্যজগতের অন্যতম নাম হলো দেব সাহিত্য কুটীর। এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬০ সালে। গুণে ও মানে এক ও অদ্বিতীয় প্রকাশনী হলো দেব সাহিত্য কুটীর। এমন কোনো বাঙালি সাহিত্যপ্রেমী নেই যারা দেব সাহিত্য কুটীরের নাম শোনেননি। বাংলা সাহিত্যের নানান ইতিহাসের সাক্ষী দেব সাহিত্য কুটীর। শিশু ও কিশোর পাঠ্য নানা ধরণের বই, ইংরেজি ক্লাসিক্সের অনুবাদ ও শারদীয়া বার্ষিকী প্রকাশে দেব সাহিত্য কুটীর অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ।
১৮৬০ সালে কোনো এক স্বর্ণালী দিনে বাংলার মায়ের উঠোনে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে যে সংস্থার উত্থান হয়, সেই সংস্থা মহীরুহ হয়ে ২০২০ সালের ১১ ই ফেব্রুয়ারী পায় 'হেরিটেজ' এর তকমা। উত্তর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রীটের ঝামাপুকুর লেনের দেব সাহিত্য কুটিরের 'হেরিটেজ' তকমা পাওয়ার একটা বছর নিঃশব্দে কেটে গেল। এই সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বরোদা প্রসাদ মজুমদার। তাঁর নামানুসারে দেব সাহিত্য কুটীরের পূর্ব নাম ছিল বিপিএম প্রেস।
বিপিএম প্রেস থেকে কিছু দূরে সুখীয়া স্ট্রিটে অবস্থিত ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মালিকাধীন সংস্কৃত প্রেসের ছাপাখানা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর সমস্ত বই এখান থেকেই ছাপাতেন। তিনি বিধবা বিবাহ আন্দোলনে যোগদান করায় প্রায় ১৫ জন বিধবাকে পুনরায় বিবাহ দেওয়ার এতো বিপুল পরিমাণে টাকা খরচ হয়েছিল যে তিনি তাঁর শখের প্রেসখানা বিক্রি করতে বাধ্য হন। এরপর ১৮৯০ সাল থেকে বিপিএম প্রেসে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় ছাপা শুরু হয়। ১৯২৪ সালে বিপিএম প্রেসের নাম বদলে রাখা হয় দেব সাহিত্য কুঠীর৷ এই ১৯২৪ সাল থেকেই বিদ্যাসাগরের সমস্ত বই ছাপার অধিকার পায় দেব সাহিত্য কুটীর।
অসংখ্য বাঙালির ছেলেবেলা ও যৌবনের সঙ্গী ছিল দেব সাহিত্য কুটীর৷ বাংলা ভাষাকে স্পষ্টভাবে চেনার পাঠ্যবই বর্ণপরিচয়, কথামালা, উপক্রমণিকা ও বোধোদয় এখান থেকেই বের হয়। বঙ্গ জীবনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শুকতারা ও নবকল্লোল পত্রিকার জন্ম হয় এখান থেকে। এছাড়াও হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেটের মতো কমিক্সের জয়যাত্রা দেব সাহিত্য কুটীরের হাত ধরেই হয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী, নারায়ণ দেবনাথ সহ লেখকজগতের কিংবদন্তি তারকা ও সঙ্গীতজগতের দিকপাল শিল্পীরা কাজের সূত্রে দেব সাহিত্য কুটীরের আদি বাড়িতে যাতায়াত করতেন। মহানায়ক উত্তমকুমার ও প্রখ্যাত অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ও এ বাড়িতে অনেক মূল্যবান সময় কাটিয়ে গেছেন। আজকে ২০২০ সালে বর্ণপরিচয়ের জন্মস্থান দেব সাহিত্য কুটীরের আদি ভবন 'হেরিটেজ' তকমা পাওয়ার পর স্ব-মেজাজে একটা বছর অতিক্রান্ত হওয়া এক ঐতিহাসিক প্রহরকে স্মরণ করিয়ে দিল।
দেব সাহিত্য কুটীরের হেরিটেজ তকমা পাওয়ার এক বছর পূর্তির প্রসঙ্গে রূপা মজুমদার বলেন "আমার মনে হয়না যে ভারতবর্ষে এমন কোনো প্রকাশনা সংস্থা আছে যাদের আদি বাড়ি হেরিটেজ তকমা পেয়েছে যেখানে বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন স্কুল এখনও পর্যন্ত হেরিটেজ তকমা পায়নি। যদিও তাকে হেরিটেজ তকমা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সেখানে আমাদের প্রকাশনা সংস্থার আদি ভবন হেরিটেজ তকমা পেয়েছে, এর থেকে গর্বের আর কী হতে পারে। আর সবথেকে বড় কথা এটা শুধু আমাদের নয়, এটা সমগ্র বাঙালির সাহিত্যজগতেরই একটা গর্ব। দেব সাহিত্য কুটীরের সাথে বাংলা সাহিত্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত।"
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment