বাঙালির বাণিজ্যে অনীহার মিথ, আসলে একটি গভীর চক্রান্ত!
চলিত কথায় বলা হয়, বাঙালি ব্যবসায়ী জাতি নয়। অনেকে আরও একধাপ এগিয়ে বলেন বাঙালি ব্যবসা পারেই না! যদিও তাদের মন্তব্যের উত্তরে দ্বারকা নাথ ঠাকুর, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, পি সি চন্দ্র জুয়েলার্স এর প্রতিষ্ঠাতা পূর্ণ চন্দ্র চন্দ্র থেকে আজকের পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়, চাউম্যানের কর্ণধার দেবাদিত্য চৌধুরী, অঞ্জলি জুয়েলার্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অনর্ঘ চৌধুরী, পোশাক ব্যবসার নক্ষত্র ফ্যাশন ডিজাইনার সব্যসাচী মুখার্জি সহ অনেকের উদাহরণই দেওয়া যায়। তালিকাটা মোটেই ছোটখাটো হবে না। এছাড়াও আছে বাংলার স্টার্ট আপ উদ্যোগীরা। যারা একদিকে যেমন নতুন ভাবনায় বাণিজ্যকে ভাবছেন অন্যদিকে রাজ্য এবং দেশের অর্থনীতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ যোগদান করছেন। এরই সঙ্গে আছে বাংলার কুটির শিল্প যা গোটা বিশ্বের দরবারে সমান ভাবে সমাদৃত।
কিন্তু 'বাঙালির দ্বারা ব্যবসা হবে না'! এই মিথ আমাদের পিছু ছাড়ে না। আসলে এই মিথ সুকৌশলে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে চাঁদ সদাগর যে বাণিজ্যের ডিঙ্গা ভাসিয়েছিলেন সেই ডিঙ্গা আজও ভেসে আছে এক অন্তঃসলিলা নদীর বুকে।
আমরা ভুলে গেছি, বলা ভালো ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে বঙ্গ লক্ষ্মী কটন মিলের ইতিহাস, আমরা ভুলে গেছি দেজ মেডিকেল প্রতিষ্ঠার কাহিনী। আমাদের স্মৃতির কুঠুরিতে জমা ধুলোয় ঢেকে গেছে বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ বা ডাকব্যাগের ঐতিহ্যময় ইতিহাস। আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয় না সাইকেল তৈরিতে একসময় বাংলা ছিল ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ। যারা কলকাতার বাসিন্দা, বিশেষ করে দক্ষিণে যাদের চলাচল তাদের মধ্যে প্রবীণরা আজও বেঙ্গল ল্যাম্প, সুলেখা কোম্পানির ইতিহাস নস্টালজিয়ার মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁচিয়ে রাখেন।
স্বদেশী যুগে বাংলায় যে শিল্প গড়ে উঠেছিল তার চরিত্র ছিল ভারতের অন্যান্য রাজ্যের ব্যবসার থেকে একেবারেই অন্যরকম। স্বদেশী যুগের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটা জেদ বা প্রমাণের তাগিদ কাজ করেছিল। তারা ব্রিটিশ সহ গোটা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে স্থানীয় ভাবে ভালো জিনিষ তৈরি করা যায়। এক্ষেত্রে তাদের জাতির প্রতি একটি আবেগ কাজ করেছিল। নিছক মুনাফা কামিয়ে নেওয়ার প্রবৃত্তির জন্য তারা ব্যবসা শুরু করেননি।
এটা বাঙালির ব্যবসার একটি ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য যা আজও প্রতিটি বাঙালি ব্যবসায়ীর মনে রাখা উচিৎ।এই জাতি সেই অদম্য জেদের উত্তরাধিকার বহন করে। তাদের আজও প্রমাণ করতে হবে, সমগ্র রাষ্ট্রের কাছে, বিশ্বের কাছে। প্রমাণ করতে হবে সৃষ্টিশীলতা, মেধা আর গুনগত মানের নিরিখে নিরিখে বাঙালি ব্যবসায়ীরা অন্যদের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে। এ যেন রূপকথার সেই রাজ্য যেখানে এক দুষ্টু রাক্ষস ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে সমস্ত রাজ্যকে।
বিশ্ব বাজারে একটা শব্দ খুবই পরিচিত, 'Kosher'। মূলত খাবার জিনিষে এই শব্দ থাকলে তার মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনা। Kosher এমনই একটি ব্র্যান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার মানে এটা ইহুদী জাতির বানানো এবং ভালো মানের। এই পণ্যগুলির দাম কিছুটা বেশি। কিন্তু ভালো মানের জন্য গোটা বিশ্বে সমাদৃত। ধর্মীয় দিকটি বাদ দিলে 'Kosher'এমন একটি ব্র্যান্ড যার অর্থ মানের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা একটি পণ্য। বাংলার স্বদেশী যুগ ও তার পরবর্তী সময়ের ব্যবসাতেও এই মানের দিকটি ছিল সবার আগে। আজকেও বাঙালি ব্যবসায়ীদের এই দিকটি সব থকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। ভালো মান হতে পারে আমাদের ব্র্যান্ড।
কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই ভারতের ব্যবসায়ী জাতগুলির থেকে বাঙালি ব্যবসার দিকে কিছুটা পিছিয়ে আছে। কিন্তু কেন? এর পিছনে আছে বঞ্চনার বিরাট ইতিহাস। ব্রিটিশ যুগের লুণ্ঠন থেকে শুরু করে , মাশুল সমীকরণ নিতি, লাইসেন্স রাজ, বিভিন্ন পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাজ্যের প্রতি উদাসীনতা, উদ্বাস্তু সমস্যার সঠিক সমাধান করার ব্যর্থতা থেকে এক সময় পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ সংকট। এই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে পশ্চিমবঙ্গের পুঁজি বাঙালিদের হাত থেকে বেদখল হয়ে গেছে।
১৭৫৭ সালে লর্ড ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করে নবাবের সম্পদ দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলা জুড়ে সেই সম্পদের লুণ্ঠন করেছে ব্রিটিশ। পুষ্ট হয়েছিল ব্রিটেনের রাজ ভাণ্ডার। বিরামহীন সম্পদের এই বহিঃস্রোত চলেছে গোটা ব্রিটিশ রাজ জুড়ে। ব্রিটেনের শিল্পের জন্য বাংলার মাটিতে নীল চাষ করে মাটিকেও বন্ধ্যা করে দিতে চেয়েছিল ব্রিটিশ। শুধু তাই নয় বাংলার উৎপাদিত সম্পদ ব্রিটিশদের হাত ঘুরে চলে গিয়েছিল তৎকালীন মাদ্রাজ এবং বম্বে প্রভিন্সে।
এক্ষেত্রে একটি তথ্য পাঠকদের মনে করাতে চাই। মাদ্রাজের তৎকালীন মুদ্রার নাম ছিল 'প্যাগাডো'। আর বাংলাকে সেই সময় বলা হতো 'প্যাগাডো বৃক্ষ'! এই অর্থনৈতিক ফলদায়ী বৃক্ষের ফল নেওয়াই শেষ কথা নয়। এই বৃক্ষটিকে সমূলে উৎপাটিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল নানা ভাবে।
বাঙালি যুবকরা যখন দেশ স্বাধীনের জন্য লড়াই করছে তখন একদল বেনিয়া ব্রিটিশের তাঁবেদারি করে অর্থ রোজগার করছিল। যখন বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের কোল খালি হচ্ছিল ব্রিটিশ বুলেটের আঘাতে তখন একদল বেনিয়া সুদের টাকা গুনছিল। ব্রিটিশের পদলেহন করছিল। যখন পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষে ফ্যান দাও; ফ্যান দাও বলে চিৎকার করছিল বাঙালি তখন তিরিশ লক্ষ্য বাঙালির লাশের উপর চালের কালোবাজারি করছিল এক দল মুনাফাখোর। যারা আজও গর্বের সঙ্গে বাংলার ব্যবসার পরিমণ্ডলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর প্রচার করছে বাঙালি অলস, বাঙালি ব্যবসা পারে না।
স্বাধীনতার পরেও অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয় নি। খুব একটা পাল্টায়নি বাংলার বঞ্চনার ইতিহাস। পলাশীর যুদ্ধের ময়দানে বাংলার সূর্যাস্ত হয়েছিল তারপর ব্রিটিশরা ১৯০ বছর ১ মাস ২২ দিন এই দেশে রাজত্ব করেছিল। কিন্তু তার পরেও বাংলার বঞ্চনার শেষ হয় নি। National Council of Applied Economic Research, Estimates of State (1950-51,1955-56 and 1960-61 Prices) এর হিসেবে দেখা যাচ্ছে ১৯৫০ সালে পণ্য উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ তখন দ্বিতীয় রাজ্য। জন সংখ্যার মাথা পিছু হিসেবে পণ্য উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম।
১৯৫১ সালে ভারত যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার শিল্প উৎপাদক সংস্থা সম্পর্কে একটি সমীক্ষা করেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রেজিস্ট্রিকৃত শিল্প সংস্থা ১,৪৯৩ টি, যা ভারতে সর্বাধিক। কিন্তু এরপর কি হলো? কেন ছয়ের দশকের পর থকেই পশ্চিমবঙ্গ পিছতে শুরু করলো?
এর পেছনে একদিকে আছে সম্পদের বিরামহীন বহিঃস্রোত অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন নীতি। এর ফলে বাংলার পুঁজিপতি গোষ্ঠী শেষ হয়ে যায়। অনেকে এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক আন্দোলনের অজুহাত তুলে ধরেন। সারা বিশ্বে ট্রেড ইউনিয়ন আছে, এবং তারা শ্রমিক স্বার্থে লড়াই করে। বোম্বে এবং মাদ্রাজে অনেক বড় বড় শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে। এবং অনেক ক্ষেত্রেই সেই আন্দোলনের সামনে মালিক পক্ষ দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
শুধুমাত্র শ্রমিক আন্দোলনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের উন্নতি হয়নি এই একমাত্রিক ধারনাটিও ভুল। কিছুটা আরোপিত। কারা ছিল এই শ্রমিক? কোথা থেকে এসেছিল তারা? আজ হাওড়া, হুগলী, আসানসোল, দুর্গাপুর শ্রমিক বস্তিগুলির দিকে তাকান। তাহলেই বুঝতে পারবেন কোথা থেকে এসেছিল এরা? কেন এদের এই মাটির অর্থনীতি, এই মাটির শিল্পের প্রতি দায় ছিল না। কেন এরা 'জিন্দাবাদ' স্লোগান দিয়ে সহজেই হত্যা করেছিল শিল্পের পরিবেশ।
ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে আছে বঞ্চনার ঘটনা। যা যুগ যুগ করা হয়েছে এই রাজ্যের প্রতি, বাঙালিদের প্রতি। আর এই বঞ্চনার ইতিহাসের দিকে চোখ যাতে না পড়ে তার জন্য হাজির করা হয়েছে মিথ, 'বাঙালি ব্যবসা পারেনা'!দখলদারির দিকে চোখ যাতে না পরে তার চেষ্টা। কারণ এর মধ্যেই দখল হয়ে গেছে বাংলার পাইকারি বাজারগুলি। বাঙালির হাত থেকে বেহাত হয়ে গেছে শিলিগুড়ি বাজার, বড়বাজার থেকে কলকাতা সহ বিভিন্ন শহরের ফুটপাত, দোকান, শিল্প থেকে অর্থনীতি।
এই রাজ্যের সরকারি টেন্ডার পেয়েছে অন্যরা। সেই টেন্ডারে পাওয়া ব্রিজ , রাস্তা বানিয়েছে অন্য রাজ্য থেকে আসা ঠিকেদার, শ্রমিক। এদিকে কাজের ঠিকানা খুঁজতে অন্য দিকে গ্রাম ছেড়ে দূরদেশে, পরিবার পরিজন ছেড়ে তাদের মুখের ভাত জুগিয়েছে বাঙালি। এই ভাবেই বড় পুঁজি হাতছাড়া হয়েছে, হাতছাড়া হয়েছে চাকরি। ব্যবসা থেকে ক্রমশ দূরে সরেছে বাঙালি। সময়ের চাকা বহুযুগ পেরিয়ে ফিরে আসে তার ফেলে যাওয়া জায়গায়। নতুন সময়ে জেগে ওঠে ইতিহাস। উত্তরপুরুষরা প্রশ্ন করে সময়কে। কি ভাবে দখল হলো আমার মাটি? আমার চাকরি? আমার ফুটপাত? আমার বাজার? কি ভাবে উৎপাদক থেকে শুধুমাত্র ক্রেতা হয়ে গেল আস্ত একটা জাতি?
প্রশ্ন থেকেই জাগ্রত হয়ে ঘুরে দাঁড়াবার শপথ। দাবি ওঠে স্থানীয় বাজার, স্থানীয় ব্যবসা, স্থানীয় টেন্ডারে অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্লোগান ওঠে পুনরুদ্ধারের, সেই সব কিছু যা দখল হয়ে গেছে। অনেক দেরিতে হলেও বাঙালির মধ্যে বাণিজ্যিক যূথবদ্ধতা দানা বাঁধে। মিছিল, সভায়, চলন্ত বাস, অটোতে আলোচনা হয় বাঙালির দোকান থেকে কিনতে হবে, ভূমিপুত্রকে অগ্রাধিকার দিতে হবে রাজ্যের টেন্ডারে।
তবে পুনরুদ্ধারের যাত্রা শুরু হয়েছে মাত্র, অনেক পথ বাকি। অধিকার দায়ের লড়াইয়ের সাথে মিলেমিশে যাচ্ছে বেঁচে থাকার দৈনন্দিন লড়াই। বহুযুগ বাদে আবার বাঙালি স্বপ্ন দেখছে অর্থনীতির উপর তার নিজের অধিকার কায়েমের। ভাবছেন সফলতা দেখে যাবে কবে? মনে রাখবেন প্রতিটি বাস্তবের পিছনে থাকে কিছু জেগে থাকা চোখ আর চোখে থাকা স্বপ্ন। বাঙালির চোখে সেই স্বপ্ন জমা হয়েছে। সেই স্বপন জয়ের স্বপন, অধিকার বুঝে নেওয়ার স্বপ্ন। সফলতা সময়ের অপেক্ষা।
প্রতিবেদন- অরিন্দম চ্যাটার্জী
Post a Comment