Header Ads

সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদারের স্বাতন্ত্র্য দর্শন ও সাহিত্যবোধ


কমল কুমার মজুমদার বাংলা সাহিত্যের একজন ব্যতিক্রমী লেখক। সৃজনশীল বাংলা সাহিত্যের গদ্যভাষা বিনির্মাণে কমলকুমার মজুমদার এক বিরলতম অধ্যায়। ১৯৬৯ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ 'অন্তর্জলী যাত্রা' প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ সালে তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ 'নিম অন্নপূর্ণা' প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রধান গল্পগুলি হল নিম অন্নপূর্ণা, শ্যামনৌকা, গোলাপ সুন্দরী, মতিলাল পাদরী, তাহাদের কথা, প্রভৃতি। পিঞ্জরে বসিয়া শুক, খেলার প্রতিভা, অন্তজর্লী যাত্রা, সুহাসিনীর পমেটম, অনিলা স্মরণে ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। দানসা ফকির তাঁর রচিত নাট্যগ্রন্থ। তিনি বিচিত্র বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি প্রধানত লিখতেন এক্ষণ, কৃত্তিবাস প্রভৃতি পত্রিকায়। বাংলার সাবেকি লোকশিল্প, কুটিরশিল্প, ধাতুশিল্প ও দারুশিল্প এবং মঠ ও মন্দির বিষয়ক বিভিন্ন দিকে তাঁর অধিকার ছিল। তাঁর ছড়ার সংকলন 'আইকম বাইকম' ও 'পানকৌড়ি'। ছড়ার বইয়ে নিজেই চিত্রাঙ্কন ও অলঙ্করণ করেছিলেন। সাউথ পয়েন্ট স্কুলে শিল্পকলা বিষয়ক শিক্ষক ছিলেন তিনি। শেষের দিকে বস্তির ছেলেমেয়েদের নাটক অভিনয় শেখাতেন। 


বাংলা কথাসাহিত্যের অতল ব্যতিক্রম কমলকুমার মজুমদার তাঁর অতুলনীয় লিখনক্রিয়ার দ্বারা 'অন্তর্জলী যাত্রা' উপন্যাসখানিতে এক অতি প্রাচীন, মুহূর্ষ পুরুষের অন্তর্জলী তথা মৃত্যুযাত্রা নিয়ে গঙ্গা তীরবর্তী শ্মশানঘাটে যে অন্ধকারময়, ভয়ঙ্করতর ও অবিশ্বাস্যপ্রায় ভাষাস্থাপত্য নির্মাণ করেছেন তা রীতিমতো বিস্ময়কর।  

বাংলা সাহিত্যে ইংরেজি সাহিত্য প্রভাবিত যে আধুনিকতার সূচনা ও বিকাশ, কমলকুমার তার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আগমন, উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন ও ঔপনিবেশিক নবজাগরণে বাঙালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ প্রতিবাদে তিনি গ্রহণ করেছেন রামপ্রসাদ, ঠাকুর রামকৃষ্ণের লোকায়ত জীবনচর্চা ও বঙ্কিমের ধর্মবোধকে।  

তাঁকে বলা হয় 'লেখকদের লেখক'। তাঁর উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ এর অনন্যপূর্ব আখ্যানভাগ ও ভাষাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। বাংলা কথাসাহিত্য বিশেষ করে উপন্যাস ইউরোপীয় উপন্যাসের আদলে গড়ে উঠছিল, কমলকুমার মজুমদার সেই পথ ত্যাগ করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের দুরূহতম লেখকদের একজন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। 

১৯৪২ এর আগস্ট আন্দোলন, ডিসেম্বরে জাপানিদের কলকাতায় বোমা বর্ষণ ইত্যাদির পর থেকে বর্হিবিশ্বে যেমন যুদ্ধে গতি জার্মানির বিরুদ্ধে তীব্র হয়ে ওঠে, তেমনি ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে তা একাধিক বিদ্রোহ-বিপ্লবে, শাসকগোষ্ঠী পর্যুদস্ত হতে থাকে। এর মধ্যে আসে খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দামোদরে বন্যা, মেদিনীপুরে প্রচণ্ড সর্ববিধ্বংসী ঝড় এবং ব্রিটিশ শাসকের ও তার ক্রীড়নক নির্বাচিত সরকারের অব্যবস্থা ও দুর্নীতিগ্রস্থতা তার পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে খ্যাত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, মহামারী। 

যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে যে আর্থিক ভয়াবহতা, অর্থনৈতিক মন্দা, বেকার সমস্যা ও মুদ্রাস্ফীতির মতো ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। হাজার হাজার লোক গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় এসে ভিড় জমাতে থাকে। এ বুভুক্ষু, নিরাশ্রয়, নিরন্ন মানুষের ছবি কমলবাবুর মনে গভীর ছাপ ফেলে। বিশেষত দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কমলকুমার মজুমদারের জীবন ও সাহিত্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।  

যুদ্ধোত্তর কলকাতার জীবন্ত চিত্র, মন্বন্তর, মুদ্রাস্ফীতি, গোরা সৈনিকের দাপট, ব্ল্যাক আউট জর্জরিত ভারতবর্ষের বর্তমানিকতার রূপায়ণে শিল্পকলার রূপ কেমন হবে, নবোদ্ভূত সমাজ সমস্যা রূপায়ণে আধুনিক শিল্পকলার ভূমিকা কী হবে -এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল কমল কুমার মজুমদারকে।  

রামমোহন থেকে কল্লোলের কোলাহল পর্যন্ত যে বাংলা সাহিত্য তা প্রধানত পশ্চিমা সংস্কৃতিশাসিত। কিন্তু রবীন্দ্র-প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ত্রিশের কবি ও ঔপন্যাসিকবৃন্দ যে পথ বেছে নিয়েছিলেন কমলকুমার মজুমদারের পথ তাঁদের থেকেও ছিল ভিন্ন। এক্ষেত্রে, রবীন্দ্র উপন্যাসের উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্তের স্থানে কমলকুমার প্রান্তিক ব্রাত্যজন, রবীন্দ্রনাথের নিরাকার পরমব্রহ্ম, জীবনদেবতার স্থানে তিনি মা আনন্দময়ীকে বেছে নিয়েছিলেন। ত্রিশ দশকের কবি, ঔপন্যাসিকরা রবীন্দ্র বিরোধিতায় যেখানে ঈশ্বরকে অস্বীকার, অস্তির স্থানে নেতিকে গ্রহণ করেছেন, তিনি সেখানে করেছেন বিকল্প শক্তি গ্রহণ। বাংলা সাহিত্যে তিনি স্বাতন্ত্র্য তুলনারহিত, একক, অদ্বিতীয়, বিতর্কে কণ্টকাকীর্ণ নিঃসঙ্গ নির্মাণ। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে 

তথ্যসূত্র- কমলকুমার মজুমদার স্বাতন্ত্র্যের সন্ধানে : শোয়াইব জিবরান।

অন্তর্জলী যাত্রা; কাহিনীশূন্য সুরম্য ভাষাস্থাপত্য : কুমার দীপ।

প্রতাপচন্দ্র সাহার ফেসবুক পোস্ট।

No comments