কাঁকুড়গাছিতে আছে প্রাচীন বাংলার নৌকারীতি দিয়ে সাজানো 'হেরিটেজ বোট মিউজিয়াম'
বাংলার মানুষ আদিকাল থেকেই নদীমাতৃক সভ্যতার ওপর নির্ভর করে জীবনধারণ করছে। তাই বাংলার জীবনযাত্রার সঙ্গে নৌকার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। প্রাচীনকালে বাংলার বণিকেরা পালতোলা নৌকাতে ভিনদেশে পাড়ি দিতো। এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলার মানুষও সেকেলে নৌকাতে যাতায়াত করতো৷ বাংলার নৌকাতে বাণিজ্য নিয়ে অনেক কাহিনী আমরা শুনতে পাই। মনসা মঙ্গল কাব্যে গাঙুড় নদীতে সপ্তডিঙা নিয়ে চাঁদ সদাগরের বাণিজ্য করতে যাওয়ার উল্লেখ আছে। সরস্বতী নদীর ওপর নৌকা নিয়েও বাণিজ্যের নানান সত্য কাহিনী ও গল্পকথা আমরা সকলেই জানি।
উত্তর কলকাতার কাঁকুড়গাছি মোড়ের কাছেই ভিআইপি রোডের ওপর 'আম্বেদকর ভবন'। যেখানে বহু মানুষের চোখের আড়ালে রয়েছে চমকপ্রদ এক সংগ্রহশালা 'হেরিটেজ বোট মিউজিয়াম'। বঙ্গ জীবনের সঙ্গে নৌকার আত্মিক যোগের কথা বলে এই মিউজিয়াম। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই মিউজিয়াম। দিনাজপুরের শিল্পীরা রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে নানা রকমের নৌকার মিনিয়েচার মডেলগুলো বানিয়েছেন। সরকারের তরফ থেকে তাঁরা পেয়েছেন পূর্ণ সহযোগিতা আর স্বীকৃতি।পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনগ্রসর জনজাতি কল্যাণ দফতর পরিচালনা করে এই মিউজিয়ামটির। নানান রকমের নৌকার অবয়ব বানিয়ে তা কাঁচের বাক্সে সংরক্ষণ করে রাখা আছে। নৌকাগুলি মূলত গামারি কাঠ, প্লাই ও বাঁশের কঞ্চি দ্বারা নির্মিত হয়েছে।
ইতিহাস বলছে আজ থেকে ২৫০ বছর আগে বাংলার ব্যবসা চলত সপ্তডিঙা মধুকর, ময়ূরপঙ্খী, অশ্বমুখী ও সিংহমুখী নৌকায় চড়ে। সাত সমুদ্র নদী পার করে বণিকেরা কোন সে দূরের দেশে পাড়ি দিতো। এই নৌকাগুলি ছাড়াও বাংলার নৌকার তালিকায় পাওয়া যায় ছিপ, ছোট, ডিঙি, ডুঙা, বাওয়ালির মতো নৌকার কথাও। এসব ছোটখাটো নৌকাগুলি তখনকার সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষেরা ব্যবহার করতো। নৌকার সঙ্গে মানুষের গভীর যোগাযোগের চিহ্নও মিউজিয়ামে তুলে ধরা হয়েছে।
এখানে ৪৬ রকমের নৌকার প্রতিলিপি রয়েছে। দুই বাংলার অজস্র প্রকার নৌকার প্রতিলিপি স্বচক্ষে দেখার সুযোগ আছে এই মিউজিয়ামে। ছিপ, ছোট, ডিঙি, কাইলে বাছারি, খেয়া, পানসি, খোরোকিস্তি, তালাই, ময়ূরপঙ্খী ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বজরা 'পদ্মা' নৌকার প্রতিলিপি সজ্জিত রয়েছে মিউজিয়ামে। কেবল দুই বাংলার নৌকার প্রতিলিপিই নয়, আছে তামিলনাড়ু, কেরালার নৌকা ও হরপ্পা যুগের নজরকাড়া শিল্পরীতিতে মোড়া একটি কবচ। অল্প আগুনে সেঁকা সেই কবচটির গায়ে অঙ্কিত আছে একটি নৌকা, তার ছইয়ের দু'পাশে দুটি পাখি, এক প্রান্তে বৈঠা।
মিউজিয়ামে রাখা আছে প্রতিটি নৌকার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের জন্য অনেক বইও। মিউজিয়ামে ঢোকার জন্য এখানে কোনো প্রবেশমূল্য নেই। সপ্তাহের সাতদিনই সকাল সাড়ে দশটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা অবধি খোলা থাকে এই মিউজিয়াম। পশ্চিমবঙ্গের কাঁকুড়গাছিতে যে এরকম সংগ্রহশালা রয়েছে একথাও অল্প সংখ্যক মানুষই জানেন। দুঃখের বিষয়, সপ্তাহের প্রত্যেকটা দিনই জায়গাটি খাঁ খাঁ করে। মাঝেমধ্যে হাতে গোণা দু'তিনজন দর্শক মিউজিয়াম ভ্রমণে আসেন৷ এমন বিরল মিউজিয়ামকে নিয়ে যে কেন মানুষের বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই সেই কথা ভাবলে খানিকটা হতাশ হতে হয়।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment