সামাজিক সংকট ও প্রেক্ষাপটে 'বেহালা আর্ট ফেস্টিভ্যাল' যেন হয়ে উঠেছিল শিল্পের প্রতিবাদী ক্যানভাস
২০২০ যে বছরটা ছিল এক বিষময় বছর। করোনা সংক্রমণ, দেশের টালমাটাল আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি, কৃষক আন্দোলন, পরিযায়ী যন্ত্রণা, আমফানের মতো দুর্যোগ আরো কত কী। ২০২০ এর দুর্দশা কাটিয়ে আমরা এখন ২০২১ এর ফেব্রয়ারীতে দাঁড়িয়ে। গত ৫ ই ফেব্রুয়ারী বেহালার মাটিতে একঝাঁক শিল্পীর নান্দনিক ভাবনায় সেখানকার রায় বাহাদুর রোড সংলগ্ন ১৪ নম্বর বাস স্ট্যান্ডের ইট-কাঠ-পাথরের কংক্রিটের জঙ্গলকে এক শিল্পপীঠ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। বেহালা নূতন সংঘের উদ্যোগে গত বছর থেকে শুরু হয়েছে 'বেহালা আর্ট ফেস্টিভ্যাল'।
৫ ই ফেব্রুয়ারী থেকে ৭ ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত চলে এই উন্মুক্ত শিল্প প্রদর্শনী। এই আর্ট উৎসবের আহ্বায়ক ছিলেন প্রথিতযশা শিল্পী সনাতন দিন্দা। এই শিল্প প্রদর্শনীর কিউরেটর ছিলেন ঐন্দ্রিলা মাইতি সুরাই। এই আর্ট ফেস্টিভ্যালে কোথাও ছবির মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে গণতন্ত্রের কথা। কোথাও পরিযায়ীর যন্ত্রণা। কোথাও কৃষক আন্দোলনের দৃশ্য। কোথাও 'মোদের কোনও দ্যাশ নাই' এর দৃশ্য। কোথাও গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যের 'অন্নপূর্ণা ও ঈশ্বরী পাটনী।' কোথাও ফুটে উঠেছে মানবজাতির সুষুম্নাকাণ্ডের প্রকারভেদ।
মনসামঙ্গলে আছে লখিন্দরের নিথর দেহ নিয়ে নেতা ধোপানির ঘাটে গিয়েছিল বেহুলা। যে জনপদ দিয়ে বেহুলা পার হয়েছিল তার নাকি বর্তমান নাম বেহালা। এখানকার প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখেই গত বছর থেকে আয়োজিত হচ্ছে বেহালা আর্ট ফেস্টিভ্যাল। চায়ের দোকান থেকে ফ্ল্যাটবাড়ির দেওয়াল, রংয়ের ছোঁয়া থেকে বাদ যায়নি কিছুই। ছবি, আলো, স্লোগান মিলিয়ে অসাধারণ এক আর্টের মেলা হলো বেহালা আর্ট ফেস্টিভ্যাল।
এ বছরের বেহালা আর্ট ফেস্টিভ্যাল ছত্রে ছত্রে মানুষকে দেখিয়েছে সামাজিক প্রতিবাদ করতে৷ প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে মানুষকে। আগামীদিনে আরো বৃহৎ আকারে এই ফেস্টিভ্যাল করা হবে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। ফেস্টিভ্যালকে ঘিরে সাধারণ মানুষের আগ্রহও ছিল চোখে পড়ার মতো। ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকেও মানুষ এসেছেন বলে জানা গিয়েছে। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ২৬ জন শিল্পী এই আর্ট ফেস্টে অংশগ্রহণ করে তাদের শিল্পকলাকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বোঝাতে তিনটি আপ্তবাক্যের ব্যবহার করেছিলেন প্রয়াত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্গন, 'বাই দ্য পিপল', 'ফর দ্য পিপল', 'অফ দ্য পিপল'। একটি বৃহৎ দেওয়াল জুড়ে শিল্পী সনাতন দিন্দা তুলে ধরেছেন লকডাউনে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলা পরিযায়ী শ্রমিকদের তৈলচিত্র। সঙ্গে লেখা ঐ তিন বাক্য। গণতান্ত্রিক ভারতে শ্রমিক শ্রেণির প্রতি কী ছিল রাষ্ট্রের ব্যবহার? সেই প্রশ্নই তোলা হয়েছে।
শিল্পী দেবজ্যোতি জানা তাঁর ছবিতে 'অনিশ্চয়ের মুখোমুখি' ভাবনায় কৃষকের ফসলের নিষ্প্রাণ নিরাপত্তারক্ষী কাকতাড়ুয়াকেই দাঁড় করিয়েছেন প্রতিবাদীর ভূমিকায়। তাঁর দাঁতকপাটিতেই স্থান পাচ্ছে সংসদ ভবন। এই চিত্রের মাধ্যমে কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবীকেই রঙ-তুলির মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন।
শিল্পী উপাসনা চট্টোপাধ্যায়ের শিল্পকর্ম 'দ্য ন্যুয়েসেন্স অফ মেমোরি: টেল মি হোয়াট ইউ রিটেন'-এর মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি ছিন্নমূল মানুষের যন্ত্রণা নিয়ে বিভেদ ভুলে মানুষের প্রতি মানুষের শিকড়ের সম্পর্কের কাহিনী। শিল্পী অনির্বাণ দাসের চিত্র 'এখনও অনেক যোজন বাকি' যার মাধ্যমে তিনি তাঁর ভাবনায় ব্যক্ত করেছেন পরিযায়ী শ্রমিকদের শুকতলা খয়ে যাওয়া জুতোর পাহাড় ও মাইলস্টোন। আরো বহু শিল্পী নানান ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন যা লিখে শেষ করা যায় না।
বেহালা আর্ট ফেস্টিভ্যালের প্রসঙ্গে এই ফেস্টিভ্যালের আহ্বায়ক সনাতন দিন্দা লিটারেসি প্যারাডাইসকে জানান "আমরা এখন অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং জল সংকট দীর্ঘ সময়ের জন্য নীরবে একটি অস্তিত্ব সংকট তৈরি করছে। আমাদের প্রাকৃতিক বাসস্থান অবিচ্ছিন্নভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, যেখানে উপযুক্ততম প্রজাতি কেবল টিকে থাকতে পারে। লড়াই যথেষ্ট ছিল না। COVID-19 সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দিয়েছে। সমাজের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। দীর্ঘ লকডাউনে মানুষ দমবন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছিল, তবুও লকডাউনের মতো একটা অস্থির পরিস্থিতি ও তার মাঝে শারীরিক দূরত্ব বজায় থাকলেও সর্বোপরি রাজনৈতিক অশান্তি এবং বর্ণ বৈষম্য কখনোই বিশ্রাম নেয় নি। এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যের দ্বারপ্রান্তে, আমরা দ্বিতীয়বারের মতো 'বেহালা আর্ট ফেস্টিভ্যাল' আয়োজন করেছি।
দ্বিতীয় বর্ষে পা দিয়ে আমরা দাঁড়িয়েও বুঝতে পারিনি যে শিল্পের মাধ্যমে এরকম একটা বিপ্লব করতে পারবো। এই ফেস্টিভ্যালে কোনো সাফল্য বা ব্যর্থতার কোনো গল্প নেই। এখানে আমরা সাবঅল্টার রাজনীতি ও সাবঅল্টার আর্ট তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। প্রায় ২৬ জন শিল্পী একত্রে মিলিত হয়ে অল্টারনেটিভ আর্ট স্পেস তৈরি করার চেষ্টা করেছে এখানে।
কলকাতার কোনো ক্লাব, কোনো পুজো কমিটি যেখানে দেবদেবী ছাড়া একটা বাঁশও পুঁততে দেবে না, সেখানে বেহালা নূতন সংঘের ছেলেরা এটা পারলো; ক্ষমতা দেখালো যে এখানে কোনো দেবদেবী নেই, কিচ্ছু নেই তারপরও আমরা একটা সেক্যুলার আর্টের কথা বলতে পারি। এতে মানুষের সঙ্গে অনেক বেশি সংযত থাকা যায়।"
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment