ফুলিয়ার তাঁতযোদ্ধা বীরেন কুমার বসাকের 'পদ্মশ্রী' জয়
বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁতশিল্প। আর বাংলার তাঁত মানেই ফুলিয়া। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায় ফুলিয়াতে আদি বসাক সম্প্রদায়ের মানুষেরাই আদিকাল থেকে তাঁত বুনে আসছে। এরা প্রধানত যাযাবর শ্রেণীর অন্তর্গত হলেও প্রথমে এনারা সিন্ধু সভ্যতার অববাহিকায় বসবাস করতেন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সিন্ধু অববাহিকা পরিত্যাগ করে তারা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে তাঁত বোনা শুরু করেন। যদিও মুর্শিদাবাদের আবহাওয়া তাঁত বোনার পক্ষে প্রতিকূল হওয়ার জন্য তারা নতুন জায়গার সন্ধান করতে থাকেন। অবশেষে বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে কাজ শুরু করেন। সেখানকার আবহাওয়াও তাঁতের জন্য প্রতিকূল তাই আবারো তাদের স্থান বদলাতে হয়। তাদের মধ্যে একদল চলে যান কিশোরগঞ্জে আর এক দল চলে যান ঢাকার ধামরাইয়াতে। আবার ধামরাইয়ের থেকে একদল চলে আসেন চৌহাট্টা অঞ্চলে৷ তারপর তারা ধামরাইয়া ও চৌহাট্টা দুটো অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যান। এরপর তাদের তাঁত দুই বাংলা জুড়ে বিস্তৃত লাভ করে। নদীয়ার ফুলিয়াতে সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করে তাঁত শিল্প। তাই বসাক সম্প্রদায়ের লোকেরা ফুলিয়াতে উঠে আসেন তাঁত বোনার জন্য। সেই থেকে আজও এখানে বসাক সম্প্রদায়ের মানুষেরাই তাঁত বুনে চলেছেন।
ফুলিয়ার বর্তমান তাঁতশিল্পীদের মধ্যে নামকরা ব্যক্তি হলেন ফুলিয়ার চটকতলার তাঁতশিল্পী বীরেন কুমার বসাক। তিনি মাত্র আট বছর বয়সেই মাকুড় কেরামতি বুঝে যান। তাই তাঁর বাবা বঙ্কুবিহারী বসাকের সাথে তিনি কলকাতায় তাঁত শাড়ি ফেরি করতে আসতেন। এই সময় থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এ শহরের নাড়িনক্ষত্র। তিনি দেখেন মানুষকে নতুন নতুন ডিজাইন দেখালে তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হবে না। তাই তিনি এই সত্যটা প্রয়োগের জন্য নীরবে কাজ চালিয়ে চান। তিনি চেষ্টা করেন কীভাবে শাড়িতে বেশি বেশি নকশা তোলা যায় ও শাড়িতে নানা রকম সুতো দিয়ে বৈচিত্র্য আনা যায়৷ এই কাজটির জন্য তিনি রাজ্যের নানান জায়গায় প্রদর্শনীতে পৌঁছে যেতেন৷ তিনি মন দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন নকশাগুলি। আর বাড়িতে ফিরে সেই সমস্ত ভাবনা শাড়িতে তুলতে থাকেন। আর এই ছকভাঙা পথ তাঁকে নতুন রাস্তা খুঁজে দেয়।
জীবনের শুরুতে বীরেনবাবু নিদারুণ কষ্টের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তবে যতই তিনি কষ্ট পান না কেন নিজের প্রতি তাঁর এক বৃহৎ আত্মবিশ্বাস ছিল। সেই আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করেই তিনি বহুদূর এগিয়ে যান৷ দাদা ধীরেন কুমার বসাকের হাত ধরে শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরেছিলেন শাড়ি বিক্রি করার জন্য। আজ সেই কষ্টের মূল্যায়ন হলো। তিনি এবার সম্মানিত হলেন 'পদ্মশ্রী' সম্মানে। দেশের এতোবড়ো সম্মান অর্জন করে তিনি নতুন করে আরো অনেক স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন৷ এখন তাঁর প্রধান লক্ষ্য গ্রামীণ উন্নয়ন ঘটানো। আজ অবশ্য তাঁর সঙ্গে রয়েছেন পাঁচ হাজার তাঁতশিল্পী। তাদের মধ্যে দু হাজার মহিলা। তিনি প্রত্যহ লোকাল ট্রেন ধরে কলকাতায় আসতেন। তিনি ও তাঁর দাদা রাস্তায় রাস্তায় শাড়ি ভর্তি ব্যাগ নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তেন। এরকম করতে করতেই তাঁরা বড় সংখ্যক ক্রেতার তালিকা তৈরি করে ফেলেন। তখন তাদের শাড়ির দাম ছিল মাত্র ১৫ থেকে ২৫ টাকা।
সত্তরের দশকের কথা, তেরো বছর বয়সে বীরেনবাবু যখন তাঁতের কাজ শুরু করেন তখন তাঁর দৈনিক আয় ছিল আড়াই টাকা। ধীরে ধীরে কলকাতায় তাঁদের তৈরি তাঁতের কদর বাড়তে থাকে। ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে কলকাতার গোলপার্কে তিনি একটি শোরুম খুলে বসেন। আজকে তাঁর ব্র্যান্ডের বার্ষিক টার্নওভার ২৫ কোটি টাকা। পৃথিবীর দীর্ঘতম তাঁত শাড়ি তোলার জন্য তিনি গিনেস বুক রেকর্ড করেন। বর্তমানে তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী। তিনি বাংলাদেশ থেকেও তাঁত বোনার ডাক পেয়েছেন। আজ তাঁর কাছ থেকে শাড়ি কেনেন ভারতীয় ক্রিকেটের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী ও বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা। অতীতে বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায় ও প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও তাঁর ক্রেতা ছিলেন। 'পদ্মশ্রী' সম্মান অর্জনের মাধ্যমে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করছেন৷ যেন জীবনের সর্বস্ব কষ্ট দূর হলো তাঁর।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment