Header Ads

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত বাগানবাড়ি হুগলির কোন্নগরেই


বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শৈশবে ছুটি কাটাতে যেতেন হুগলির কোন্নগরে গঙ্গার তীরে অবস্থিত তাদের বাগানবাড়িতে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথাতেও এই বাগানবাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি এখানেই নৌকো চড়া, দৌরাত্ম্য ও শিকার শিখেছেন। এই বাগানবাড়িতে বসেই তিনি প্রথম কুঁড়েঘর আঁকতে শিখেছিলেন। এই বাড়ি ছিল গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এখানে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। 'ক্ষীরের পুতুল', 'বুড়ো আংলা', 'রাজকাহিনী'র মতো অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টি তিনি কোন্নগরের বাগানবাড়িতেই করেছেন। 


গরমের ছুটিতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুররা সপরিবারে এখানে আসতেন। গঙ্গার তীরে সবুজে মোড়া এক নান্দনিক স্থান হলো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত কোন্নগরের বাগানবাড়ি। যার মূল বাড়িটি করোনা পরিস্থিতির জন্য বন্ধ রাখা আছে। এই বাড়িতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবি, জিনিসপত্র, ইতিহাস সাজিয়ে মিউজিয়াম করার দাবী তুলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গঙ্গার পাড়ে বুড়ো বট, আম, বকুল, তাল, কাঁঠাল ও স্বর্ণচাপা গাছের সারি রয়েছে। বড় বড় গাছ নকশা করে সারিবদ্ধ ভাবে বাঁধানো আছে। বাগানে টিয়ে, ফিঙে, বাবলার ও হাঁড়িচাচাদের ডাকাডাকি শুনতে পাওয়া যায়। প্রকাণ্ড বাগানে রংবেরঙের প্রজাপতিদের ভিড়ও লক্ষ্য করা যায়। 

কোন্নগরের ২ নম্বর মীরপাড়া লেন। বাড়ির গা দিয়ে বইছে গঙ্গা নদী৷ সেকেলের নদীপ্রবাহ, মাঠঘাট, কুঁড়েঘরের স্মৃতি ভিড় করত ভারতীয় চিত্ররীতির পুরোধা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবীণ বয়সে। 'জোড়াসাঁকোর ধারে' তার সাক্ষী। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাল্যকালের স্মৃতিবিজড়িত এই বাগানবাড়ি। প্রায় ১১ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছিল এই বিশাল বাগানবাড়িটি। কোন্নগর পুরসভার রেকর্ড বলছে, মূল ভবন একটি। ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তিনটি করে ঘর।  রান্নাঘর ও স্নানের জায়গা আলাদা। রয়েছে লম্বা সিঁড়ি ও খোলা বারান্দা। বাইরে গাড়ি রাখার দোচাল গ্যারাজ। 

১৫ নম্বর ওয়ার্ডে জিটি রোডের ধার ঘেঁষে সরু ইটের রাস্তাটাই হলো মীরপাড়া লেন। কয়েক পা এগোলে বাগানবাড়ির লোহার তৈরি প্রবেশদ্বার। যে প্রবেশদ্বার কয়েক বছর ধরে মরচে ধরা অবস্থায় অযত্নে ছিল। ২০১৮ সালে পুরসভার তরফে গেটে রঙ করে লিখে দেওয়া অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়ি। ভিতরটি ছায়া সুনিবিড়। প্রাচীন আমলের সোনালি পাথরের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি ইট বিছানো পথ। ভবনের ডানদিকে অবন ঠাকুরদের ফিটন। ভিতরটি ছায়া সুনিবিড়৷ রচারপাশে শুকনো পাতার স্তূপ। ভবনের ইটের রঙ ফিকে। ভবনের সামনেই শিল্পীর স্মৃতিমাখা পুরানো কাঁঠাল গাছ। এক কোণে মাজার। যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ বিশেষ সময়ে আসেন প্রার্থনার জন্য।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই  বাগানবাড়ি ২০০৭ সালে হেরিটেজ তকমা পাওয়ার পরও বহুদিন ধরে অবহেলা-অযত্নে পড়েছিল৷ পৌরসভারও কোনো হেলদোল ছিল না বাগানবাড়িটি নিয়ে। ২০১০ সালে প্রমোটার রাজ শুরু হয় এ বাড়িটিকে ঘিরে। পৌরসভার হাত থেকে লাখোটিয়া গ্রুপ বাগানবাড়ির দখল নিতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। বাগানবাড়ি ভেঙে তারা বহুতল নির্মাণের পরিকল্পনা করতে থাকে৷ কিন্তু কোন্নগরের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ছাত্রসমাজ সকলেই তৎপর হয়ে ওঠে বাগানবাড়ি বাঁচাতে৷ আইনি পথে আন্দোলন করে প্রশাসনকে চাপ দিতে থাকে তারা। এই আন্দোলন বৃহৎ থেকে বৃহত্তর আকার ধারণ করে। 

প্রবল আন্দোলনের চাপে সাড়া দেয় কোন্নগর পৌরসভাও। সাধারণ মানুষকে লাখোটিয়া গ্রুপ অর্থের প্রলোভন দেখাতে থাকে। যদিও তাতে কোনো সাধারণ মানুষ কোনো রকম আগ্রহ দেখায় নি। লাখোটিয়া গ্রুপের লোকেরা কোন্নগরের সাধারণ মানুষকে নানাভাবে ভয় দেখাতে থাকে। কিন্তু কোন্নগরের স্থানীয় বাসিন্দারা সেই ভয়কে অবজ্ঞা করে এক দীর্ঘ লংমার্চের আয়োজন  করেছিল। কোন্নগরের সাধারণ মানুষ, শিল্পী ও ছাত্র-যুবসমাজ পায়ে হেঁটে কোন্নগর থেকে নবান্ন ও জোড়াসাঁকো পর্যন্ত পৌঁছে দেয় তাদের আন্দোলন। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে চলা এই আন্দোলন শেষ হয় গত বছরের মার্চে। প্রমোটার রাজ ধ্বংস করে এখন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়িকে নবরূপে সজ্জিত করা হয়েছে। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে


1 comment: