Header Ads

নির্মীয়মান শপিং কমপ্লেক্সের দাপটে বিপর্যস্ত বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি


শপিং কমপ্লেক্সের কোপে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি। যদিও এই বাড়িতে তিনি কখনো থাকার সুযোগ পাননি। ১৯৫০ সালে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের  মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী রমা বন্দোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে ব্যারাকপুরে 'আরণ্যক' নামে এই বাড়ি তৈরি হয়েছিল। তাঁর পরিবার পাঁচ দশক করে এখানে বসবাস করছেন। বর্তমানে 'আরণ্যক' এ উড়ে গেছে সমস্ত শান্তি। তাঁদের বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে শপিং কমপ্লেক্স। যার জেরে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।  


সাহিত্যিক তারাদাস বন্দোপাধ্যায়ের স্ত্রী তথা বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পুত্রবধূ মিত্রা বন্দোপাধ্যায়ের মুখে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠার ব্যাপারটি শোনা গেছে। লিটারেসি প্যারাডাইসের প্রতিনিধিরা তাঁর সাথে যোগাযোগ করে পুরো বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছে। তাঁর কাছে যা কিছু জানা গেল তা অত্যন্ত নিন্দনীয় ব্যাপার। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের মতো একজন কিংবদন্তি সাহিত্যিক তথা বাংলার গর্ব মানুষদের পরিবারগুলোর সাথে এমন আচরণ কখনোই কাম্য নয়। 

শ্রীমতী মিত্রা বন্দোপাধ্যায় জানান যে --- "২০১৯ থেকে আমাদের বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে ছয় থেকে সাত তলার একটা শপিং কমপ্লেক্স বানানো হচ্ছে। আমার ধারণা কোনো বাড়ি করতে হলে তিন ফুট ছাড় দিতে হয় ওরা সেটা দেয়নি। পাড়ার জল নিকাশী ব্যবস্থার জন্য যে নর্দমা তার জল আটকে রেখে কাজ শুরু হয়। আমাদের বাড়ির পিছনের পাঁচিল ভয়ঙ্কর ভাবে দূরমুষ দিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং আমাদের অনুমতি ছাড়াই ওরা পাঁচিলের পাশের গাছগুলোকেও কেটে দিয়েছে। এই সমস্ত অত্যাচার, তারপর হাতুড়ির প্রচণ্ড শব্দে আমাদের বাড়ি থরথর করে কাঁপছে। আমরা রাতের বেলা কিংবা দিনের বেলা ভালো করে ঘুমোতে পারছি না। সারাদিন ধরে ওখানে কাজ চলছে। যার ফলে আমাদের বাড়ির জানালার কাচ খুলে পড়ে যাচ্ছে, দেওয়ালের প্লাস্টার খসে যাচ্ছে, বাড়ির রান্নাঘরে রাখা কাপ ডিস্ক পড়ে যাচ্ছে ও বাড়ির সমস্ত ঘরে ফাটল ধরে একদম ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে আমরা দিন কাটাচ্ছি। 

আমার শ্বশুরমশাইয়ের নামে যে স্মারক ঘরটি আছে তাতে আমি শ্বশুরমশাইয়ের স্মৃতিধন্য সমস্ত পুরানো জিনিসপত্র সেখানে রেখে দিই। পাড়ার নর্দমা থেকে সেই স্মারক ঘরে জল ঢুকে শ্বশুরমশাইয়ের লেখা এদেশীয় অনুবাদ বই, লেখনী ও যে পাণ্ডুলিপিগুলো রয়েছে তা ভিজে একাকার হয়ে গেছে ও বিভিন্ন জিনিসপত্র বিশেষ করে শ্বশুরমশাইয়ের জামাকাপড় পচে নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ স্মারক ঘরটিতে জল বেরোবার কোনো পথ নেই। যার জন্য আমরা দুটো মার্বেল দিয়ে বাড়িটিকে উঁচু করি। যা যথেষ্ট ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। পাড়ার নর্দমা বুজে যাওয়ার জন্য এই বর্ষায় যে প্রচুর বৃষ্টি হলো, সেই বৃষ্টির জল ঢুকে গিয়ে আরো অনেক জিনিস নষ্ট হলো। ওদের যখন ইলেকট্রিকের কাজ হচ্ছিল তখন আমাদের পুরো বাড়ি কারেন্ট হয়ে যায় আমাদের বাড়ির পাঁচিলের সাথে ওদের কমপ্লেক্সটি সংযুক্ত থাকার জন্য। আমি বাথরুমে স্নান করছিলাম সেদিন। কারেন্টের প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে আমার পড়ে গিয়ে হাতের কব্জী ভেঙ্গে যায়৷ 

বহু জায়গায় আমরা দরবার করে দেখেছি এদের কোটি কোটি টাকার ব্যবসা, আমাদের মতো ক্ষুদ্র সীমিত ক্ষমতার লোকেরা আমরা কী করতে পারি? আমরা বিস্ময়ের সীমা অতিক্রম করে চলেছি প্রতিদিন। আমি এবং আমরা সাধারণ জনগণ কতটা অসহায় সেটাই ভাবছি। মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা হুমকী দিয়ে বলছে যা করার করে নিন আপনারা। কোনো পাড় থেকে এখন জল বেরোয় না। আমাদের পাশের কিছু বাড়িতেও সারাক্ষণ জল জমে  ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। তারাও পৌরসভাতে পিটিশন করেছিল ও চিঠি লিখে বিবৃতি দিয়েছিল। তাদেরও ওরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন কিচ্ছু করা যাবে না। ওরা কোনোরকম পিটিশনকে গ্রাহ্যই করেনি। দুবছর আগে পৌরসভার তখনকার চেয়ারম্যান উত্তম দাসকে বিষয়টি জানানোর পর উনি একটি চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে বাড়িটি ওরা মেরামত করে দেবেন অথবা ক্ষতিপূরণ দেবেন। আজ দুবছর হয়ে যাওয়ার পরেও কোনো কাজ হয়নি। এমনকি ওরা আমাদের সাথে দেখা পর্যন্ত করেননি। আমি দুশ্চিন্তায় এখন হার্ট ও নার্ভের পেশেন্ট হয়ে পড়েছি।" 

প্রশাসন ও কোর্ট-কাছারির দ্বারস্থ হয়েও কোনো সমাধান খুঁজে পাননি তাঁরা। অসহায় ভাবে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন কাটছে তাঁদের। তাঁরা জানেন না যে আর কতদিন মাথার ওপর ছাদটা থাকবে তাদের। বাঙালিরা এখন এতোটাই হীনমন্যতায় ভুগছে যে বাংলার ঐতিহ্য-কৃষ্টি রক্ষাতে যেন তারা দায়বদ্ধ নন। বাঙালির শুভবুদ্ধি জেগে উঠতে কেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে বাঙালি এ প্রশ্নও উঠছে। তাহলে কথা হচ্ছে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পরিবারকে বাঁচাবে কে বা কারা? বাঙালি আদৌ বাঁচাতে পারবে তো বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পরিবারকে? প্রশ্ন উঠবেই। প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। আমরা চাই বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি ও তাঁর পরিবার কঠিন এ লড়াইতে জয়ী হয়ে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচুক। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments