Header Ads

ধর্মতলাতে বাংলা পক্ষের সমাবেশে ভূমিপুত্র সংরক্ষণের দাবীতে উঠলো জোরালো আওয়াজ


১৭ ই জানুয়ারী কলকাতার ধর্মতলার রানী রাসমণি রোডে  বাংলা পক্ষের তরফে এক ঐতিহাসিক মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়। বাংলার ইতিহাসে এই প্রথমবার ভূমিপুত্র সংরক্ষণ নিয়ে এতো বড়ো সমাবেশ দেখা গেল কলকাতার মাটিতে। হাজার হাজার মানুষের জমায়েতে জনসমুদ্র হয়ে উঠেছিল সভাস্থল। রাজ্যের ২২ টি জেলা থেকে বহু মানুষ এই সভাতে অংশ নেন। বাংলা পক্ষের সকল প্রতিনিধি, সংগঠক ও সহযোদ্ধারা নিজেদের বক্তব্যের মাধ্যমে ভূমিপুত্র সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। 


এ রাজ্যে ভূমিপুত্র সংরক্ষণের জন্য বাংলা পক্ষ একগুচ্ছ দাবির কথাও তুলে ধরেছে। যেমন সরকারি চাকরিতে ১০০ শতাংশ ভূমিপুত্র সংরক্ষণ, বেসরকারি চাকরিতে ৯০ শতাংশ ভূমিপুত্র সংরক্ষণ, উচ্চশিক্ষায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে ৯০ শতাংশ সংরক্ষণ এবং ব্যবসা, টেন্ডার ও হকারির লাইসেন্সে ৯০ শতাংশ সংরক্ষণ।

বাংলা পক্ষ এই সমাবেশে ভারতের কোন কোন রাজ্যে কত শতাংশ ভূমিপুত্র সংরক্ষণ  আছে তার একটা পরিসংখ্যানও তুলে ধরে। যে পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, গোয়া, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক ও ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্যে ইতিমধ্যেই ভূমিপুত্র সংরক্ষণ আইন কার্যকর করা হয়েছে। যে পরিসংখ্যানে পরিস্কার যে বাইরের রাজ্যে বাঙালি ছেলেমেয়েদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা প্রতিদিন কমছে। তাই আমাদের রাজ্যে বেকারত্ব কমাতে চাই ভূমিপুত্র সংরক্ষণ। 

১৭ তারিখের ধর্মতলা সমাবেশের প্রসঙ্গে বাংলা পক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অধ্যাপক ড. গর্গ চট্টোপাধ্যায় লিটারেসি প্যারাডাইসকে জানান "গত ১৭ ই জানুয়ারী বাঙালির বাঁচার দাবি নিয়ে ধর্মতলায় বাংলা পক্ষের ডাকে বাঙালি জাতির বিপুল সমাবেশ সব বাঙালির কাছে বার্তা - এবার বাঙালি জাতির নিজের স্বার্থ বুঝে নিতে হবে। বহিরাগত তোষণ আর মানা হবেনা। সব চাকরিতে, ব্যবসায়, ঠিকা ও লাইসেন্সে ভূমিপুত্র সংরক্ষণ চাই। বাঙালি যুবসমাজ বাংলা পক্ষের পতাকাতলে এক হচ্ছে। এই বাংলায় সবকিছুর দখল নেবে বাঙালি - এটাই বাংলা পক্ষের লক্ষ্য এবং ১৭ জানুয়ারীর মহাসমাবেশের বার্তা। জেলায় জেলায় সে বার্তা ছড়িয়ে গিয়ে এখন তা ব্যাপক সংগঠিত রূপ ধারণ করেছে। বাঙালির শত্রুরা এবং তাদের দালালরা সাবধান।"

এই মহাসমাবেশ নিয়ে বাংলা পক্ষের অন্যতম সংগঠক কৌশিক মাইতি জানান "বাংলায় সামনে বিধানসভা ভোট আসছে। গত তিন বছর ধরে বাংলা পক্ষ বাংলা ও বাঙালির দাবিতে সোচ্চার। কিন্তু এই বিধানসভা ভোটে বাঙালির ভাগ্য নির্ধারণ হবে। ভোটের কেন্দ্রবিন্দুতে কী বাঙালি থাকবে? ভোটের পরে বাঙালির স্বার্থ কী সুরক্ষিত থাকবে? বাঙালির চাকরি কী থাকবে? ভোটের কেন্দ্রবিন্দুতে যাতে বাঙালি থাকে, বাঙালির স্বার্থ ও চাকরি যাতে সুরক্ষিত হয় তার জন্যই ছিল বাংলা পক্ষের এই মহাসমাবেশ। এতোদিন আমরা বিভিন্ন দলকে জেতাতে লড়তাম আর ১৭ তারিখ ধর্মতলায় বাঙালি লড়েছে নিজেকে জেতানোর জন্য, নিজের জাতিকে জেতানোর জন্য ও নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জেতানোর জন্য। এ লড়াই এক অনন্য লড়াই। এই লড়াই বাংলা তথা ভারতের মাটিতে প্রথমবার।"

বাংলা পক্ষ পশ্চিম বর্ধমান শাখার সম্পাদক অক্ষয় বন্দোপাধ্যায় বলেন "এই সমাবেশ এক ইতিহাস সৃষ্টি করলো কলকাতার বুকে, সকল জেলা থেকে প্রতিনিধিরা এসে তাদের নিজের জেলার দাবি জানিয়েছেন, এটা একমাত্র বাংলা পক্ষেই সম্ভব। পশ্চিম বর্ধমান জেলা হিন্দি আগ্রাসনে ভরে গেছে। সকল কাজ, ঠিকা ও টেন্ডার সব বহিরাগতদের দখলে। কোনো বাঙালি ও স্থানীয়রা কাজ পায় না, পায় শুধু ধূলো আর কালি। তাই এই সময় ভুমিসন্তান সংরক্ষণ না করলে বাকি জেলা গুলোরও অবস্থা পশ্চিম বর্ধমানের মতো হয়ে যাবে। সব বহিরাগত লোকেরা দখল করে নেবে। ভুমিসন্তান সংরক্ষণ হলে সকল বাঙালি আগে কাজ পাবে। আমাদের যা কিছু দখল হয়েছে বাইরের রাজ্য থেকে আসা মানুষদের দ্বারা, আমরা তা আবার সব পুর্নদখল করবো।"

বাংলা পক্ষের কলকাতা শাখার সম্পাদক অরিন্দম চ্যাটার্জি বলেন "বাংলা পক্ষের ১৭ ই জানুয়ারীর সমাবেশ বাংলা তথা বাঙালির ভবিষ্যতের দিক নির্দেশকারী একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলার বুকে এই সমাবেশ প্রথম বাঙালি হিসেবে তার চাকরি, বাজার, পুঁজির দাবিকে সোচ্চারে তুলে ধরল। বাংলার প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে আসা বাংলা পক্ষের সদস্য, সহযোদ্ধা ও সমর্থকদের উপচে পড়া ভিড় জানান দিলো নতুন বছরের হাত ধরে যে নতুন দশক শুরু হয়েছে সেই দশক বাঙালির অধিকার আদায়ের, বাঙালির দখল হয়ে যাওয়া সম্পদের পুনর্দখলের, বাংলার আগামী দশক জাতীয়তাবাদের দশকে পরিণত হতে চলেছে।"

বাংলা পক্ষ মালদা শাখার সহযোদ্ধা রাফিক আহমেদ বলেন "আমি মালদা জেলার একটি গ্রামের ছেলে। আমি কোন দিন এত টা আশা করিনি যে জেলার ছেলেদের দাপট বাড়বে। অনেক রাজনৈতিক দলের মিটিং হয়েছে সমাবেশ হয়েছে কিন্তু এভাবে বাঙালির ডাকে বাঙালির সমাবেশ হয়নি। আমি গর্বিত যে এমন একটি ঐতিহাসিক সমাবেশে আমি থাকতে পেরেছিলাম মালদা বাংলা পক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে।"

বাংলা পক্ষ পুরুলিয়া শাখার সহযোদ্ধা তারক হাজারি জানান "এই সমাবেশ বাংলা পক্ষের কাছে রীতিমতো একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, অহিন্দি জাতির প্রতি বঞ্চনা ইত্যাদির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে একটা বার্তা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। সভাস্থল যেভাবে ভিড়ে ঠাসা ছিল তা অকল্পনীয়। সুদূর শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি থেকেও এসেছিলেন বহু সহযোদ্ধারা। কোনোরকম আর্থিক সাহায্য ছাড়াই সহযোদ্ধাদের এত স্বতস্ফূর্ততা প্রমাণ করে বর্তমান সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্ৰয়োজনীয়তাকে।

সেদিনের সভামঞ্চে বেশিরভাগ জুড়েই প্রায় প্রত্যেক জেলার বক্তারা ছিলেন, তারা নিজের জেলার কথা কলকাতার রাজপথে তুলে ধরেছেন নিজেদের মতো করে। অন্য সমস্ত রাজনৈতিক দল বা সংঠনের মত কলকাতাকেন্দ্রিক না হয়ে জেলার বক্তাদের এই প্রাধান্য নিঃসন্দেহে আগামীর জন্য শুভ।

তবে একথা উল্লেখযোগ্য যে সেদিনের সভায় দীর্ঘদিন পর স্বকীয় মেজাজে দেখা গেছে বাংলা পক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অধ্যাপক ড. গর্গ চট্টপাধ্যায়কে। তার কথামতো আগামীতে বাংলা পক্ষ ব্রিগেড সমাবেশের ক্ষমতা রাখে। তাঁর সেদিনের আগুন ঝরানো বক্তব্যে উঠে এসেছে বহিরাগতদের দখলদারি পুনরুদ্ধারের প্রসঙ্গও। ছিলেন আরেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কৌশিক মাইতি, যিনি তার বক্তব্যে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন দেবার আহবান জানিয়েছেন। 

সবমিলিয়ে শুধু বার্তা দেওয়ায় নয়, এই সমাবেশ কার্যত বিভিন্ন জেলার সহযোদ্ধাদের কাছে এক মিলনমেলা হয়ে উঠেছিল, যা বাঙালির ইতিহাসে, বাংলার জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।"

বাংলা পক্ষের উত্তর ২৪ পরগণা শিল্পাঞ্চলের সম্পাদক  ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন "আজ এক সরকার আছে কালকে হয়তো অন্য সরকার আসবে কিন্তু বাংলা পক্ষ কোনোদিনও বাঙালিদের ছেড়ে যাবে না। বাঙালির অধিকার রক্ষার জন্য সবার প্রথমে দরকার ভূমিপুত্র সংরক্ষণ। আমরা বহুদিন ধরে এই ইস্যু নিয়ে লড়ছি। ১৭ তারিখ ধর্মতলার মাটিতে দাঁড়িয়ে বাংলা পক্ষ সকল বাঙালিকে জানালো যে ভূমিপুত্র সংরক্ষণ না হলে বাঙালির এ রাজ্যে কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। ভূমিপুত্র সংরক্ষণের জন্য আমাদের এই লড়াই বাঙালির অস্তিত্বের লড়াই। বাংলায় কত শতাংশ হিন্দু ও কত শতাংশ মুসলিম আছে বাংলার মানুষ তা জানতে চায়না। বাংলার মানুষ  এখন শুধু জানতে চায় বাংলাতে কত শতাংশ বাঙালি আছে।"

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments