Header Ads

পাখি নিয়েই চলতো তাঁর সাধনা, এক বিস্তৃতপ্রায় বাঙালি পক্ষীবিদ সত্যচরণ লাহা


আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা পাখি বা পাখিদের নিয়ে চর্চা করতে ভালোবাসেন। কেউ কেউ তো এমনও আছেন যাঁরা জীবনের একমাত্র প্যাশন হিসেবে বেছে নেন পাখি নিয়ে চর্চাকে। বলাবাহুল্য, এই প্যাশন বাঙালিদের মধ্যেও দেখা যায়। এবার যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় একজন বিখ্যাত ভারতীয় পক্ষীবিদ বা অর্নির্থোলজিস্টের নাম, তাহলে অনেকেই বলবেন বিশ্ববিখ্যাত 'সেলিম আলি'- র নাম। হয়তো, সেলিম আলির নামটা অনেকের কাছে বেশি পরিচিত, অনেকে তাঁর ও তাঁর কাজ সম্পর্কে বেশি শুনে থাকেন বা পড়ে থাকেন যেমনটা থাকেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা এবং একই সাথে বিখ্যাত পক্ষীতত্ত্ববিশারদ অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম তথা এ.ও.হিউম-কে। অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউমকে তাঁর ভারতীয় উপমহাদেশে পাখি নিয়ে বিপুল চর্চার জন্যে বলা হয় 'ভারতীয় পক্ষীবিজ্ঞানের জনক' বা 'ফাদার অফ ইন্ডিয়ান অর্নিথোলজি'। নিঃসন্দেহে, এঁরাই হয়ে উঠেছেন দেশের অনেক পাখি বিশেষজ্ঞদের অনুপ্রেরণাদাতা বা উৎসাহদাতা। কিন্তু আমরা ক’জন জানি বাংলার বিখ্যাত পক্ষীতত্ত্ববিদ সত্যচরণ লাহা-কে? সবচেয়ে বড়ো বিস্ময়কর ব্যাপার হল এই যে, সত্যচরণ লাহা বিজ্ঞানের ছাত্র না হওয়া সত্বেও সারা জীবন পাখি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা করে গেছেন। দেশের এমনকি বিশ্বের তাবড় তাবড় পক্ষীবিদের আলোয় হয়তো ঢাকা পড়ে গিয়েছেন বিস্মৃতপ্রায় এই বাঙালি পক্ষীবিদ।


উত্তর কলকাতার কৈলাস বসু স্ট্রিট। সেখানকার বিখ্যাত লাহা পরিবারে  সত্যচরণ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৮ সালে। তাঁর পিতা হলেন অম্বিকাচরণ লাহা ও মাতা হলেন কিরণবালা দেবী। সত্যচরণ পড়াশোনা করেছিলেন মেট্রোপলিটন কলেজে ও প্রেসিডেন্সি কলেজে। তিনি ইতিহাস নিয়ে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। আইনবিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্থাৎ বি.এল. ডিগ্রিও লাভ করেছিলেন। কিছুকাল স্বনামধন্য ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট বা আই.এস.আই-এর কোষাধ্যক্ষ হিসেবে সত্যচরণ কাজ করেছিলেন। ইতিহাস ও আইন নিয়ে পড়াশোনা করলেও তাঁর মন পড়ে থাকত প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে বিশেষ করে পাখি বিষয়ে। তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করতেন মাঠে-ঘাটে-বনে-জঙ্গলে-বাদাড়ে সব বিচিত্রময় পাখিদের আচার-আচরণ, বাসা তৈরি, শাবক প্রতিপালন ইত্যাদি বিষয়। আসলে, ছাত্রাবস্থা থেকেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পাখি সম্পর্কে তাঁর কৌতুহল ছিল অপরীসিম। তাঁকে বিভিন্ন পাখি অনুসন্ধান বা পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ও ঝুঁকি নিয়েও কাজ করতে হয়েছে। 

বিভিন্ন ধরণের পাখি সংগ্রহের প্রতি তাঁর এত নেশা ছিল যে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি সংগ্রহ করে ১৯২৮ সালে চল্লিশ বছর বয়সে কলকাতার নিকটবর্তী আগরপাড়ায় তিনি একটি পাখি-নিকেতন গড়ে তুলেছিলেন। শুধুমাত্র খাঁচায় বন্দী করে রাখা পাখিদের পর্যবেক্ষণ করা ছাড়াও স্বাভাবিক অবস্থাতেও পাখিদের কেমন আচার-আচরণ তা নিয়েও পর্যবেক্ষণ করতেন কেননা ওই যে বলা হল মাঠে-ঘাটে-বনে-জঙ্গলে-বাদাড়ে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছিলেন বিভিন্ন ধরণের পাখিদের আচার-আচরণ নিয়ে পর্যবেক্ষণের জন্য। এমনকি, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বা বিজ্ঞান সম্মতভাবে পাখিকে কিভাবে পোষ মানানো যায় তা নিয়েও কাজ করেছিলেন।

আমাদের আলোচ্য এই পক্ষীবিদ  সাহিত্যে বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যেও বিশেষ পারদর্শীতা দেখিয়ে গেছেন। যদিও তাঁর প্রবন্ধের সিংহভাগই ছিল পাখি সম্পর্কিত। পাখি সম্পর্কে তাঁর নানা পর্যবেক্ষণের কথা মাতৃভাষা বাংলায় অত্যন্ত সহজ-সরল করে তিনি লিখে গেছেন তৎকালীন যুগের বিখ্যাত বিখ্যাত সব পত্র-পত্রিকায়। সেই পত্রিকাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মর্মবাণী ইত্যাদি। সাধারণ প্রবন্ধের পাশাপাশি পাখি বিষয়ক তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বোম্বের জার্নাল অফ  ন্যাচারাল হিস্ট্রি, এভিকালচার, আইভিস-সহ বিভিন্ন বিখ্যাত সাময়িকীতে। বাংলাতেও তাঁর গবেষণাধর্মী লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ১৩৩১-৩২ সনে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর 'পুরুলিয়ার পাখি' সম্পর্কিত একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। এখানে উল্লেখযোগ্য এই যে, সত্যচরণ নিজেও একটি বাংলা বিজ্ঞান পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সেই পত্রিকার নাম ছিল 'প্রকৃতি' আর এই পত্রিকায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা প্রকাশিত হত বলে বাংলার পাঠক সমাজে যথেষ্ট খ্যাতিলাভ অর্জন করেছিল। শুধু জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখাই বাংলার পাঠক সমাজকে এই  পত্রিকা উপহার দেয় নি, বাংলা বিজ্ঞান পরিভাষা সৃষ্টির ব্যাপারে এই পত্রিকার যথেষ্ট অবদান ছিল। এই পত্রিকায় পরিভাষা বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে গেছেন একেন্দ্রনাথ ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ রায়, উমাপতি বাজপেয়ীর মতো দিকপাল পণ্ডিতেরা। সত্যচরণ নিজেও তাঁর পত্রিকায় অনেক উঁচুমানের অথচ সাধারণ বাঙালি পাঠকের পাঠযোগ্য এমন অনেক প্রবন্ধ লিখেছিলেন যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য 'মহাভারতের পাখী', 'হংস' ও ধারাবাহিকভাবে লেখা 'পাখির বাসা' ইত্যাদি। শুধু পাখি নয়, এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে অতিকায় সরীসৃপদের নিয়ে লেখা তাঁর প্রবন্ধ 'সরীসৃপ'। এছাড়াও আরও অনেক প্রবন্ধ তিনি লিখেছিলেন। ১৯৩৭ সালে মননশীল লেখক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর সাহিত্য সহায়ক হন।

শুধু কি প্রবন্ধ? তা নয়, সত্যচরণ লাহা পাখি বিষয়ক একাধিক বই লিখে গেছেন যেগুলোকে বলা যায় বাংলা পাখি বিষয়ক সাহিত্যের 'গোল্ড মাইন'। সেই সমস্ত বইগুলো হল– ১৯২১ সালে অর্থাৎ প্রায় শতবর্ষ আগে প্রকাশিত 'পাখীর কথা' (যার ভূমিকা লিখেছিলেন স্বয়ং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী), ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত 'কালিদাসের পাখী' এবং তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত 'জলচরী' সহ একাধিক বই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সমগ্র জীবন জুড়ে পাখি নিয়ে গবেষণা করে গেছেন সত্যচরণ লাহা। তাঁর এই প্রচেষ্টা কখনো ব্যর্থ যায়নি কেননা দেশ-বিদেশের নানা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এই যে, সত্যচরণ লাহা ছিলেন আলিপুর চিড়িয়াখানার প্রথম ভারতীয় সভাপতি। তার আগে কিছু কালের জন্য সেখানকার সহ সভাপতিও ছিলেন। সুবিখ্যাত 'এশিয়াটিক সোসাইটি' এবং স্বনামধন্য বিজ্ঞানী আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রতিষ্ঠিত 'বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ'- এর তিনি ছিলেন আজীবন সদস্য। 'ব্রিটিশ অর্নিথোলজিস্টস' ইউনিয়ন’-এর সদস্য ছিলেন তিনি। সব থেকে গর্বের বিষয় হল এই যে, ইংল্যান্ডের বিশ্ববিখ্যাত ‘লন্ডন জুলজিক্যাল সোসাইটি' তাদের ফেলো হিসেবে নির্বাচন করে এই বাঙালি পক্ষীবিদকে।

স্বনামধন্য বাঙালি পক্ষীতত্ত্ববিশারদ, ধনী প্রকৃতিবিদ, অপেশাদার পক্ষীবিদ, শিক্ষাবিদ এবং কলকাতার অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবী সত্যচরণ লাহা ১৯৮৪ সালের ১১ই ডিসেম্বর আমাদের ছেড়ে চলে যান। আগামীদিনের পাখি-প্রেমীদের জন্য তিনি রেখে যান তাঁর সুদীর্ঘ ৯৬ বছরের পক্ষীচর্চার নিদর্শন। 


তথ্যসূত্রঃ- বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি বিজ্ঞানী (প্রথম খণ্ড)- রণতোষ চক্রবর্তী, জ্ঞান বিচিত্রা।

টেলিগ্রাফ  

No comments