Header Ads

বাউলের মাস্টারপিস 'মনের মানুষ' এর দশ বছর


গতকাল ছিল ১০ ই ডিসেম্বর। এই দিনেই আজ থেকে দশ বছর আগে মুক্তি পায় জনপ্রিয় বাংলা ছবি 'মনের মানুষ'। স্বনামধন্য পরিচালক গৌতম ঘোষ পরিচালনা করেছিলেন এই ছবির। লালন ফকিরের জীবন কাহিনী উঠে এসেছিল এই ছবির মধ্য দিয়ে। বাংলা ছবির ইতিহাসে মাইলস্টোন তৈরি করেছিল 'মনের মানুষ'। বাংলার শহর থেকে গ্রাম-মফঃস্বল প্রতিটি জায়গার মানুষের কাছেই প্রশংসিত হয় এই ছবি। ইন্দো-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনাতে মুক্তি পেয়েছিল এই ছবি৷ ওপার বাংলাতেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এই ছবি৷ লালন ফকিরের ভূমিকায় এই ছবিতে অভিনয় করেন সবার প্রিয় অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। 


'মনের মানুষ' ছবিতে লালন ফকির যেন জীবন্ত রূপে ধরা দিয়েছিলেন। প্রসেনজিৎ লালন ফকির চরিত্রটি দূর্দান্ত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর মুখ-ভঙ্গিমা, চাল-চলন ও কণ্ঠ মিশিয়ে সাক্ষাৎ লালন ফকির যেন তাঁর মধ্যে ভর করেছিলেন। এতোটাই শক্তিশালী ছিল তাঁর অভিনয় এই ছবিতে। নিজের চেনা ইমেজকে একেবারেই পাল্টে ফেলেছিলেন তিনি। জীবনে প্রথমবার কোনো বাউল ফকিরের চরিত্রে তিনি অভিনয় করলেন। লালন ফকিরের মতো এমন চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাওয়া যে-কোনো অভিনেতার কাছেই বড়ো পাওনা। মনের মানুষ শুধু বাংলা চলচ্চিত্রের জগতেই নয়, স্বয়ং প্রসেনজিৎ এর জীবনেও একটা বিশেষ জায়গা অধিকার করে রেখেছে। মনের মানুষ ছবির স্মৃতি এখনও তিনি ভুলতে পারেন নি। গতকাল অভিনেতা নিজের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে মনের মানুষের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এক আবেগঘন পোস্ট করেন সেখানে তিনি লেখেন "আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে আজকের দিনেই মুক্তি পেয়েছিল 'মনের মানুষ', যেটা দুই বাংলার সিনেপ্রেমী মানুষের কাছে অত্যন্তভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। আমি কৃতজ্ঞ আমার প্রতিটি দর্শক, বিশেষভাবে পরিচালক গৌতম ঘোষ-এর কাছে আমায় 'লালন ফকির'-এর মতো একটি চরিত্রে ভাবার জন্যে।"

'মনের মানুষ' ছবিতে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরিত্রে প্রিয়াংশু চ্যাটার্জী, লালনের মা পদ্মাবতীর চরিত্রে গুলশন আরা চম্পা, সিরাজ সাঁইয়ের চরিত্রে রইসুল ইসলাম আজাদ, কালুয়ার চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী, গোলাপির চরিত্রে সুদেষ্ণা শ্যামপ্রভা, কোমলির চরিত্রে পাওলি দাম ও কাঙাল হরিনাথের চরিত্রে অভিনয় করেন শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়। এই একঝাঁক তারকা মনপ্রাণ দিয়ে অভিনয় করেছিলেন এই ছবিতে। সকলের অভিনয় এ ছবির মাধ্যমে বাংলা ছবির জগতে নতুন করে তৈরি করেছিল একটা মাস্টারপিস পিরিয়ড।   

কিংবদন্তি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'মনের মানুষ' অবলম্বনে এই ছবি তৈরি হয়। ছবির কাহিনীতে আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে লালন ফকিরের সাক্ষাতের সেই ঘটনা যেখানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লালনের একটি পোট্রের্ট এঁকেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লালনের সাথে বাউল দর্শন নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন। এই আলোচনার মাধ্যমে লালনের জীবনকাহিনী দর্শকদের সামনে উপস্থাপিত হয়। 

ঊনিশশো শতকে বাংলা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে জর্জরিত হয়ে ওঠে। জাতপাত নিয়ে লোকেরা ব্যস্ত হতে থাকে। অনেকটা জাত গেল, প্রাণ গেল গেল র মতো অবস্থা। লালন ফকির সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। তিনি বাউল গেয়ে সকল ধর্মের মানুষকে একসূত্রে বেঁধে দেন। লালন ফকির সমাজের শুদ্ধিকরণের জন্য সংগ্রাম করতেন। এসব ঘটনাই পুরো ছবিতে উঠে এসেছে। 

পরিচালক গৌতম ঘোষ 'মনের মানুষ' ছবির প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন "ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের একটা রেনেসাঁ হয়েছিল, তার একটা সুদূরপ্রসারী ফলও আমরা দেখতে পেয়েছি। কিন্তু তার সমান্তরালে অসহিষ্ণুতা, অসাম্যতার বিরুদ্ধে আরেকটা স্রোত চলছিল। যেখানে একটা মুক্তচিন্তার অস্তিত্ব ছিল। তখন থেকে আঠারো শতকের উদারপন্থী ঐতিহ্য ঢুকে গেছে আমাদের উচ্চশ্রেণী বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে। কিন্তু এর পাশাপাশি যে সমান্তরাল একটা চিন্তাভাবনা যার কাব্যময়তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল সেই-ইতিহাস নিয়ে আমাদের খুব একটা কাজ করা হয়নি। পরবর্তীতে গবেষণা হয়েছে লালন ফকিরকে নিয়ে। অন্যান্য সম্প্রদায় নিয়েও গবেষণা শুরু হয়েছিল। আসলে অনেকদিন ধরেই ইচ্ছা ছিল শুধু লালন বা তাঁর মতো চরিত্রকে নিয়ে কাজ করার। যাদেরকে একটা সমান্তরাল স্রোত বা চোরা স্রোত বলা যেতে পারে। কিন্তু তাদের বিচরণ ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে নিম্নবর্গীয় মানুষ; যাদের সমাজ নিচু জাত বলে। উচ্চশ্রেণীর সঙ্গে এদের কোনো যোগাযোগ নেই। এসব মানুষের চিন্তাভাবনা খুব উচ্চস্তরের ছিল, সেটা অনেকেই জানে না।"

গতকাল দশ বছর পার করলো এই ছবি। এখনও টেলিভিশনে এই ছবিটি দেওয়া হলে বহু লোকে সপরিবারে দেখে। এই ছবিটি থেকে যে অনেককিছু শেখার আছে। তাছাড়াও লালন ফকিরের বিখ্যাত সব গান মন দিয়ে উপলব্ধি করতে হলেও এ ছবিটি দেখতে হবে। দশ বছর পরেও লোকের মুখে মুখে ঘুরছে এই ছবির কথা। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments