Header Ads

ইতিহাস ও বর্তমানকে সাঙ্গ করে হেরিটেজের তকমা নিয়ে আজও ঐতিহ্যের বহনকারী আন্দুল রাজবাড়ি


সেই রাজাও নেই আর রাজপাটও নেই কিন্তু ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে হাওড়ার বিখ্যাত রাজবাড়ি 'আন্দুল রাজবাড়ি'। যার বয়সে জরাজীর্ণের ছাপ। সহস্র স্মৃতির শিকড় আবদ্ধ রেখেছে এই রাজবাড়ি। ২০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করছে আন্দুল রাজবাড়ি। হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে মৌরীগ্রামের পরবর্তী স্টেশন আন্দুলে নেমে টোটো বা রিক্সা ধরলেই আপনি পৌঁছে যাবেন এই রাজবাড়িতে।  


আন্দুল রাজবাড়ি তৈরি হওয়ার পিছনে এক লম্বা ইতিহাস রয়েছে। ১৮৩৪ সালে রামলোচন রায়ের বংশধর রাজা রাজনারায়ণ রায়বাহাদুর প্রতিষ্ঠা করেন আন্দুল রাজবাড়ি। যদিও আন্দুল রাজপরিবারের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রামচরণ রায় যার সমকাল বিচার করলে দেখা যায় পলাশীর যুদ্ধের ও আগের ঘটনা। রামচরণ রায়ের আদি বংশপরিচয় পর্যালোচনা করলে জানা যায় তিনি আন্দুলের প্রাচীনতম জমিদার পরিবার দত্তচৌধুরি বংশের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন।কাশীশ্বর দত্তচৌধুরির জামাতা গৌরিশংকর বসু মল্লিক আন্দুলে প্রতিষ্ঠা করেন মল্লিক পরিবার। গৌরিশংকর তাঁর ভগ্নিপতি ভুবনেশ্বর করকে আন্দুলে কর বংশ প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়তা করেছিলেন। দত্তচৌধুরির ঐশ্বর্য ও প্রতিপত্তি এই দুটো পরিবারের উত্থানে অনেকাংশে সাহায্য করেছিল। কর পরিবার তাদের নিজ উদ্যোগে সেই গৌরব বহুলাংশে বাড়িয়ে দেন ও তৎকালীন নবাবের কাছ থেকে রায় উপাধি লাভ করেন।    

রাজা রামলোচন রায় তার পিতার জীবদ্দশায় জমিদারির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। অত্যন্ত বিদ্যান রাজা রামলোচন আন্দুল ও পাশ্ববর্তী এলাকায় টোল, চতুষ্পাঠী ও আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তিনি ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় সুদক্ষ ছিলেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর ভান্সিটার্ট তাঁকে তাঁর দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত করে। শেষ জীবনে তিনি কলকাতার পাথরিঘাটার বাসভবনে থাকতেন। মহারাজ নন্দকুমারের জালিয়াতির বিচারের সময় তিনি ছিলেন সরকার পক্ষের প্রধান সাক্ষীদের অন্যতম ও এই মামলায় তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসকে যথেষ্ট সাহায্য করেন। কালীঘাটের মন্দিরের সামনে তিনি তৈরি করলেন একটি নাটমন্দির। আন্দুলের প্রথম রাজবাড়ি তাঁর তৈরি। ১৭৭০ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত দুর্গাদালানে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয়। 

আন্দুলে অবস্থিত এক প্রকাণ্ড মাঠ তার পাশে অবস্থিত সেই বিশাল রাজপ্রাসাদ। বাড়ির সামনে শুধু মধ্যভাগে গোটা গোটা ১২ টি স্তম্ভ, একেকটি স্তম্ভের উচ্চতা প্রায় ৬০ ফুট। একসময় এই অংশটিকে রাজবাড়ির নাচঘর বলা হতো। এককালে রাজবাড়ির ভেতরে ছিল ২০ টি বাহারি স্তম্ভ। যে স্তম্ভের ওপর থেকে ঝুলতো বড়ো বড়ো ঝাড়বাতি। এই নাচঘরে বাঈজিদের আসর বসতো। ঐ ভবনের দু'পাশে তিন তলা দুটি ভবনের অংশ আজও আছে। প্রতিটি তলের উচ্চতা ২০ ফুট। এখন এই তিনতলাতেই পরিবারের বর্তমান সদস্যরা বসবাস করেন। 

আন্দুল রাজবাড়ি বর্তমান সময়ে হেরিটেজ বিল্ডিং এর মর্যাদা লাভ করেছে। ভবনের সামনে থাকা বৃহদাকার খোলা মাঠের একসময় সরস্বতী নদীর পাড় পর্যন্ত বিচরণ ছিল। এখন ক্ষীণতনু, রাজবাড়ির চত্বরে আর দেখা যায় না। 

মূল ঠাকুরদালানের দু'পাশে আছে সাতটি করে শিব মন্দির। ঠাকুর দালানের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে, ডান দিকের শিবলিঙ্গগুলি একে অন্যের থেকে দু'ইঞ্চি করে বড়। আর বাঁ দিক ঠিক তার উল্টো। শিব মন্দিরগুলোর বেশিরভাগই ভগ্নপ্রায়। কিন্তু মূল মন্দিরটি একেবারে ঝাঁ চকচকে।  

মন্দিরে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে একটি কামান৷ দুর্গাপুজোর বিসর্জনের সময় দাগা হতো এই কামানটি। এখানকার দুর্গাপুজো প্রায় ২৫০ বছরের পুরানো। রাজবাড়ির প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন ঘটে মহাসাড়ম্বরে। সেই বছরের পুজোতে জাঁকজমকতার কোনো খামতি রাখা হয়নি৷ রাজবাড়ির প্রথম দুর্গাপুজোতে রবার্ট ক্লাইভ রাজবাড়িতে হাজির হলেন দশ হাজার টাকার সন্দেশ, ১০৮ টি নীলপদ্ম ও এক হাজার টাকা প্রণামি নিয়ে। 

আন্দুল রাজবাড়িতে দুর্গাপুজো এখনও বৈভব ও আড়ম্বরের সাথে অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বে রাজবাড়ির নিকটস্থ মাঠে মেলা বসতো। লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত পুরো রাজবাড়ি। সপ্তমীর ১২ দিন আগে থেকেই রাজবাড়িতে পুজোর ধুম লেগে যেত। সপ্তমীর সকালে কামান দেগে ঘট উন্মোচন করা হতো। এই কামানের আওয়াজে আন্দুলবাসীরা বুঝতে পারতো যে আন্দুলে পুজোর শুভারম্ভ হলো। এখানকার পুজোতে আগে মহিষ ও পাঁঠাবলি দেওয়া হতো। দুর্গা প্রতিমাটি সাজানো হতো সনাতনী ডাকের সাজে। আন্দুল রাজবাড়ির দুর্গাপুজো ২৫০ বছর অতিক্রম করলেও পুজোর জৌলুস এতটুকুও কমেনি। পুজোতে এখন যেটুকু পরিবর্তন এসেছে তা হলো এই পুজোতে বন্ধ করা হয়েছে বলিপ্রথা। আগে পুজোতে প্রচণ্ড আওয়াজে কামান দাগা হতো কিন্তু এখন কামান দাগা হয় নিঃশব্দে। বংশ পরম্পরায় আজও ঐতিহ্য বহন করে চলেছে আন্দুল রাজবাড়ির। 

তথ্যসূত্র- কলিকাতা দর্পণ (রাধারমণ মিত্র), গল্পকুঠির, হাওড়া জেলার ইতিহাস (অচল ভট্টাচার্য), শ্যামলস ব্লগ, বঙ্গদর্শন

No comments