Header Ads

ভারতের প্রথম কীট-পতঙ্গের বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য || চতুর্থ পর্ব

       

গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের বিভিন্ন পোকামাকড়ের মধ্যে মাকড়সা নিয়ে গবেষণা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্ত্রী ও পুরুষ মাকড়সার আচার-ব্যবহারর পার্থক্য ও গঠনের পার্থক্য, সঙ্গমের পর পুরুষ মাকড়সাকে স্ত্রী মাকড়সার গিলে ফেলা, ডিমের প্রতি স্ত্রী মাকড়সার মাতৃসুলভ যত্ন করা, মাকড়সাদের মধ্যে নৃশংস আচার-আচরণ, মেছো বা মাছ-শিকারি মাকড়সা, ডুবুরি মাকড়সা, টিকটিকি শিকারি মাকড়সা, পিঁপড়ে-আকৃতির মাকড়সা(যা তাঁর ভাষায় পিঁপড়ে-অনুকারী মাকড়সা)– এই সমস্ত মাকড়সাদের সম্পর্কে গোপালচন্দ্র বিশেষ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এইসব পর্যবেক্ষণের কথা তাঁর প্রচুর লেখায় ফুটে ওঠে। এমনকি নতুন প্রজাতির মাকড়সাও তাঁর পর্যবেক্ষণের অধীনে রেখেছিলেন। এই নতুন মাকড়সাটির  নামকরণ হয়েছিল মাইকোরিয়া ফলতানা (Micoria faltana) যার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় ‛সায়েন্স এণ্ড কালচার’ পত্রিকার ১৯৩৫ সালের প্রথম খণ্ডের তৃতীয় সংখ্যায়। মাকড়সার মতোন পিঁপড়ের জীবন-রহস্য সম্পর্কেও তাঁর পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্যবেক্ষণের প্রসঙ্গে বলা যায় যে, একবার তিনি এ এক প্রজাতির পিঁপড়েদের পাতার পরিবর্তে কৃত্রিমভাবে স্বচ্ছ সেলোফেন কাগজ দিয়ে বাসা বানাতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আমরা জানি যে, সেলোফেন স্বচ্ছ। আর তাই সেলোফেনের বাসার ফলে, বাইরে থেকে পিঁপড়েদের আচার-আচরণ, ঘর-সংসার সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করতে পারতেন। গবেষণার প্রতি তাঁর এতটাই নিষ্ঠা ও বুদ্ধিমত্তা কাজ করত।

পোকামাকড়ের আচার-আচরণ তো বটেই এমনকি এদের হাতিয়ার সম্পর্কেও তিনি গবেষণা করেছিলেন। এইসব নিম্ন-শ্রেণীর প্রাণীদের জীবনে চলার ও বাঁচার অস্ত্র সম্পর্কেও তো জানতে হবে আমাদের, তাই নয় কি? মানুষ বরাবরই  ভেবে এসেছে যে, সেই হয়তো একমাত্র প্রাণী যারা যে কোনো বাইরের জিনিসকে শারীরিক কাজের সম্পূরণ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সে সমস্ত জিনিসকে আমরা বলি যন্ত্র বা টুল। তা, সব প্রাণীকেই তো বাঁচার জন্য বা জীবন ধারণের জন্য যন্ত্র বা টুল ব্যবহার করতে হবে। হাতি, শিম্পাঞ্জি– এইসব প্রাণীদের আচার-আচরণের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যে, এরা গাছের ডাল বা এ ধরনের সামগ্রী বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে থাকে। পোকামাকড়ের  ক্ষেত্রে এই যন্ত্র ব্যবহারের রেওয়াজ থাকতেই পারে, জীবন ধারণের জন্য ব্যবহার করাটা তো অসম্ভব নয়। গর্বের কথা, বাঙালি কীটপতঙ্গবিদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য এদেশে আরও অন্যান্য পর্যবেক্ষণের মতো পোকামাকড়ের বিভিন্ন যন্ত্র হিসেবে প্রাকৃতিক বস্তুর ব্যবহার করার বিষয়টি প্রথম দেখান। তাঁর এ ধরণের পর্যবেক্ষণের ফলে উঠে আসে যে,কুমোর পোকা ডিম পাড়বার পর গর্তের মুখ বন্ধ করার জন্যে এক খণ্ড ভারি মাটির টুকরো সংগ্রহ করে তা গর্তের মুখে বারবার ঘা দেয়। অনেকটা হাতুড়ির মতো ব্যবহার করে আর কি! আরেক জাতের পোকার ক্ষেত্রে তিনি দেখেছিলেন যে, তারা তাদের পায়ের কাদা মাখিয়ে সেটাকে যন্ত্র বা টুল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এখন পোকামাকড়ের বিভিন্ন যন্ত্র বা টুল ব্যবহার নিয়ে নানান গবেষণা চলছে। কিন্তু বাংলায় তথা ভারতে, এ ব্যাপারে পথিকৃৎ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য স্বয়ং।

গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য যেমন কীটপতঙ্গের আচার-আচরণ নিয়ে গবেষণা করে গবেষণাপত্র লিখেছেন তেমনি বাঙালি আপামর পাঠক সমাজের জন্যেও যাতে সকলে কীটপতঙ্গের সম্পর্কে বা অন্যান্য প্রাণীদের সম্পর্কে জানতে পারেন, সেজন্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এদের সম্পর্কে জনপ্রিয় রচনা লিখে গেছেন। আসলে, কেবলমাত্র গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ করেই তিনি ক্ষান্ত ছিলেন না। বলা যায়, তিনি তাঁর অধিকাংশ পর্যবেক্ষণ বিষয়ক লেখা সহজ, সরল বাংলা ভাষায় নানা পত্র-পত্রিকায় লিখে গেছেন। বিজ্ঞানকে সাধারণের মাঝে বিশেষ করে বাঙালি পাঠকের মাঝে পৌঁছে দেবার তাঁর এই নিজস্ব প্রচেষ্টা বা প্রয়াস সত্যি খুবই প্রশংসনীয়। বাংলা বিজ্ঞানচর্চায় বা বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যে তাঁর লেখা এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছিল। কীটপতঙ্গ বা পোকামাকড় নিয়ে গবেষণার প্রসঙ্গে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন এদেশের কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় নিয়ে  গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ।


 

No comments