Header Ads

ভারতের প্রথম কীট-পতঙ্গের বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য || দ্বিতীয় পর্ব


ছোটবেলা থেকেই গোপালচন্দ্র ছিলেন ব্যতিক্রমী। কেননা, তিনি ছোটবেলা থেকেই হাতে কলমে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন। এতে লেখাপড়া আরও ভালো হয় কেননা যা শেখা হচ্ছে তার যথার্থ মর্মার্থ বোঝা যায়। তা, লোনসিং স্কুলে তিনি ভূগোলের শিক্ষকতা করতেন। তা শিক্ষক হিসেবে তিনি গতানুতিক ক্লাসরুমের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেন না। কেবলমাত্র, ছাত্রদের ক্লাস নিয়েই তিনি ক্ষান্ত ছিলেন না। সেই স্কুলের শিক্ষকতার মাঝে ছাত্রদের নিয়ে একটি বাগান গড়ে তোলেন। সেবা বাগানে তিনি যে কত রকম পরীক্ষা করেছিলেন তার জো নেই।তিনি অনেক সময় গ্রামদেশের বনবাদাড়, ঝোপ-জঙ্গল এমনকি পরিত‍্যক্ত জায়গাতেও ঘুরে বেড়াতেন। তিনি ছিলেন একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। গতানুতিক শিক্ষকতার বাইরের জগতের  তথা প্রকৃতির কথাও তিনি ভাবতেন। গোপালচন্দ্র ব্যস্ত থাকতেন বিভিন্ন রকমের কীটপতঙ্গের গতিবিধি, আচার-আচরণ ইত্যাদি নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। তিনি যা কিছু নতুন দেখতে পেতেন তাই সারদাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত 'কাজের লোক' পত্রিকার জন্য পাঠাতেন। তাঁর বেশ কয়েকটি লেখা ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেই সমস্ত লেখাগুলি বেশ ছোট ধরণের। তাদের মধ্যে 'অনৈসর্গিক পরাগ-সঙ্গমে গাছের ফলোৎপাদনে অদ্ভুত ক্ষমতা',  'উদ্ভিদকে ঢেঙা ও জোরালো করিবার উপায়' ইত্যাদি। এই লেখা দুটি ছোট হলেও, নামে ও মানে বেশ বড়ো। এই 'কাজের লোক' পত্রিকার প্রসঙ্গে বলা যায় যে, একশো বছর আগে, ১৯২০ সালে গোপালচন্দ্র নিজেই এই সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক হন। এই পত্রিকা ছাড়াও, তিনি 'সনাতন' নামের একটি পত্রিকারও দায়িত্ব নিয়েছিলেন।


তখন হাতে লেখা কাগজ বেরোত। এমনকি বিখ্যাত ঠাকুর বাড়ি থেকেও। দুঃখের বিষয় এইসব হাতে লেখা কাগজগুলি (এমনকি ঠাকুরবাড়ির গুলিও) বেশিদিন চলেনি। যাইহোক, এই হাতে লেখা পত্রিকার মধ্যে অন‍্যতম ছিল 'শতদল' যার সম্পাদনা করতেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর প্রথম জীবনে। এই মাসিক পত্রিকা নানা ধরণের লেখায় সমৃদ্ধ ছিল। নিবন্ধ তো ছিলই, এছাড়া ছিল ছড়া, কবিতা, গল্প, কবিগান ও জারিগান। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের এই প্রবন্ধের নায়ক বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন জারিগানের একজন উঁচুমাপের শিল্পী। এই 'শতদল' পত্রিকাও বেশিদিন আর চললো কোথায়! যাইহোক, তাঁর বিজ্ঞান লেখার মধ্যে অন‍্যতম 'পচা গাছপালার আশ্চর্য আলো বিকিরণ করবার ক্ষমতা' যা প্রকাশিত হয়েছিল তৎকালীন বিখ্যাত 'প্রবাসী' পত্রিকার ১৩২৬ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায়। 'প্রবাসী' পত্রিকা বিখ্যাত ছিল কারণ তখনকার দিনের বাঙালি বুদ্ধিজীবী মাত্রই ছিলেন এই পত্রিকার পাঠক। এই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। আর গোপালচন্দ্রের ওই লেখাটি উল্লেখযোগ্য কেননা এই লেখাটি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর পড়ে খুব ভালো লেগেছিল। 

'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশিত উক্ত লেখাটির ব্যাপারে কিছু কথা বলা যাক। তখন গোপালচন্দ্র গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। একবার বর্ষাকালের সন্ধ্যার পর তিনি এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা লক্ষ্য করেন। তিনি দেখেন যে দূরে মাটি থেকে তিন-চার হাত উঁচুতে হঠাৎ করে আগুনের গোলা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। অনেকেই ব্যাপারটা দেখেছেন কিন্তু তাঁরা সবাই সেটাকে 'ভূতুড়ে আলো' বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু গোপালচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক মন তা মানে কীভাবে? অতএব, তিনি কৌতুহলী হয়ে অনুসন্ধানে নামলেন। হারিকেন ও হাতে লাঠি নিয়ে গেলেন আগুনের কাছে। তিনি বুঝতে পারলেন যে এটা কোনো ভৌতিক ব্যাপার নয়। অন্য কোনো কারণে এই আগুন জ্বলছে। সেই আলোর তেমন তীব্রতা ছিল না তবুও নীলাভ আলোয় চারপাশ ছেয়ে গেছে। তিনি দেখলেন একটা গাছের গুঁড়ি থেকে আলোটা বেরোচ্ছে। সেই গুঁড়ির অনেকটাই যেন পচে গেছে। তিনি কতগুলো পচা গুঁড়ির টুকরো যাদের থেকে আলো ছড়াচ্ছে তা সংগ্রহ করে নিলেন। কিন্তু, কেন এই পচা কাঠের টুকরো থেকে আলো বিকিরণ হচ্ছে তার নির্দিষ্ট কারণ তিনি তখন শত চেষ্টাতেও বুঝে উঠতে পারেননি। বরঞ্চ, কৌতুহলী পাঠকের উপর তা ছেড়ে দিয়েছেন। গোপালচন্দ্র সেই প্রবন্ধের শেষে লিখেছেনঃ-

"শিকড়ের দিকটা বৃষ্টির জলে ভিজে তখন আলো বের হচ্ছিল। ওই পচা লতাপাতার মত ছায়ায় থেকে পচেছিল এ বিষয়ে আসল রাসায়নিক তথ‍্যটা প্রবাসীর মারফৎ সবিস্তারে কেউ জানাতে পারলে আমাদের কৌতূহল দূর হত। কারো পরীক্ষার দরকার হলে ওরকম দু-এক টুকরো আলো-দেওয়া পচা পাতা বা আর কিছু পাঠাতে পারি।"

যাইহোক, এবার ফিরে আসি গোপালচন্দ্রের সাথে জগদীশচন্দ্রের সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গে। যে সময় তাঁর রচনাটি আচার্য জগদীশচন্দ্রের সুনজরে পড়েছিল তখন তিনি কলকাতায় চলে এসেছিলেন এবং থাকতেন উত্তর কলকাতার কাশীপুরের সৃষ্টিধর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। এই সৃষ্টিধর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন গোপালচন্দ্রের আদি বাড়ি ফরিদপুর জেলার প্রতিবেশী। আসলে, কলকাতায় গোপালচন্দ্র চাকরি খুঁজছিলেন। আর পেয়েও গেলেন গঙ্গার ধারে 'বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স'-এর অফিসে টেলিফোন অপারেটরের চাকরি। কিন্তু চাকরি তাঁর ভালো লাগলো কই? তাঁর কৌতুহলী ও অনুসন্ধিৎসু মন কি চায় টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কাজ করতে? আর এদিকে প্রবাসীতে প্রকাশিত তাঁর বিজ্ঞান রচনাটি পড়ে আচার্য বসুও তাঁর মতো একজন গ্রামের বিজ্ঞান-অনুসন্ধিৎসু ব‍্যক্তির সাথে কথা বলতে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। তা অবশেষে, বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস গোপালচন্দ্রকে আচার্য বসুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। নানান কথা সেদিন হয়েছিল বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের। প্রথম সাক্ষাৎকারেই গোপালচন্দ্রের বিজ্ঞানের প্রতি অসীম আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হয়ে জগদীশচন্দ্র বসু বলেছিলেন, "যদি তুমি এখানে আসতে চাও, তবে অনেক কিছু শিখতে পারবে।" 'এখানে' বলতে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত নবগঠিত দেশের অন্যতম সেরা বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান 'বসু বিজ্ঞান মন্দির'- কে বোঝানো হয়েছে। নিঃসন্দেহে, আমরা বলতে পারি যে, সেদিনের এই দুই বিজ্ঞান সাধকের সাক্ষাৎকার এদেশের প্রাকৃতিক বিজ্ঞান তথা জীববিজ্ঞানের প্রেক্ষাপটে এক ঐতিহাসিক ও চিরস্মরণীয় মুহূর্ত।



No comments