Header Ads

বাংলার লোকগীতি ও বাউল গানকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চান এক স্কটিশ গিটারিস্ট


বাংলার লোকসঙ্গীত ও বাউলের এক জগৎজোড়া খ্যাতি রয়েছে। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলা গানের ক্ষমতা ঠিক এতোটাই। বাংলা ভাষার গান যে শুধু বাঙালিই শোনে এমনটা সকলেরই ভুল ধারণা। ভারতের অন্যান্য জাতির মানুষও বাংলা গান শোনেন। উপমহাদেশের সমস্ত দেশ ছাড়িয়ে বাংলা গানের শ্রোতা এখন সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়েও। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষও বাংলা গান পছন্দ করেন। তারা মূলত বাংলার বাউল ও লোকগীতির অতিরিক্ত প্রশংসা করে থাকেন। 
লোকসঙ্গীতের প্রসঙ্গে এক স্কটিশ ব্যক্তি বলে থাকেন "লোকসঙ্গীতে সরাসরি আবেগ প্রকাশ করা যায়। ক্ল্যাসিক্যালের সঙ্গে লোকসঙ্গীত যোগ করলে সেটি অন্যরকম লাগে। তাৎক্ষণিক অনেক কাজের সুযোগ আছে লোকগানে। দর্শকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ সৃষ্টি, সুর নিয়ে খেলা। দর্শকরাও খুব সহজে লোকগানের ছন্দ আবিষ্কার করতে পারেন৷" ঐ স্কটিশ ব্যক্তির নাম সাইমন থ্যাকার, যিনি পেশায় একজন ক্ল্যাসিক্যাল গিটার বাদক। আজকের এই প্রতিবেদনটি এই সাইমন থ্যাকারকে নিয়েই।   

বাউল গানের টান ও সুরের বন্ধনে নিজেকে আবদ্ধ করে মায়া খোঁজেন সাইমন থ্যাকার। স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা লোকসঙ্গীত ও বাউল তিনি অত্যন্ত ভালোবাসেন৷ তিনি মাঝেমধ্যেই বাংলা গানের প্রতি আবেগ প্রকাশ করেন৷ তিনি বাংলা ভাষা সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে না পারলেও বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকগান ও বাউল তাঁর বড়োই প্রিয়। হৃদয় দিয়ে তিনি বারংবার বাংলা ভাষাকে অনুভব করেছেন। বাংলার লোকগীতি-বাউল গানকে তিনি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন।      

সাইমন থ্যাকার স্কটল্যান্ডের অন্যতম জনপ্রিয় গিটারিস্ট। তিনি বাংলা লোকসঙ্গীতের টানে সূদুর স্কটল্যান্ড থেকে উড়ে আসেন বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে। লোকসঙ্গীতে যে গভীর মাটির টান লুকিয়ে থাকে, একথা তিনি অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করেন৷ সম্প্রতি তিনি বিভিন্ন দেশের ১৯ জন স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে গাইলেন 'আমরা করব জয়' গানটি।    

ইন্টারনেটের সূত্র ধরে বাউল গানের সাথে তাঁর সম্পর্ক তৈরি হয়। ইউটিউবে প্রতিনিয়ত তিনি সন্ধান করেন বাংলার সব ঐতিহ্যবাহী গান৷ অন্তর্জালের মাধ্যমে তিনি পরিচিত হন কুষ্টিয়ার জনপ্রিয় বাউলশিল্পী ফরিদা ইয়াসমীনের সাথে। ফরিদার হাত ধরে সাইমনের জানার জগত আরও বিস্তৃত হতে থাকে। তিনি বাউল গান নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে চিনে ফেলেন লালন ফকির ও শাহ আব্দুল করিমকে। এনাদের গান নিয়ে বলতে গেলে তিনি এককথায় পাগল। লালনের গানের টানে গিটার কাঁধে তিনি কুষ্টিয়াতে উপস্থিত হন। তারপর কুষ্টিয়া থেকে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতন পাড়ি দেন৷ এই শান্তিনিকেতনেই রাজু দাস বাউলের সাথে তাঁর সখ্যতা তৈরি হয়৷ সাইমন থ্যাকার রাজু দাস বাউল ও ফরিদা ইয়াসমিনকে নিয়ে একযোগে গান বাঁধেন। 

সাইমন থ্যাকার বাংলার যে বাউল দলগুলোর সাথে কাজ করেন সেখানে কেউ ইংরেজি জানেন কিন্তু বাংলা জানেন না, আবার কেউ বাংলা জানেন কিন্তু ইংরেজি জানেন না। তাদের এভাবে গানের মাধ্যমে যোগাযোগকে তিনি টেলিপ্যাথির সাথে তুলনা করেন৷ তাদের  দলের কেউই একই ভাষায় কথা বলেন না। তবে গানের ভাষাতে তারা একে অপরকে বুঝতে পারেন। সাইমনের মতে "জোহান সেবাস্টিয়ান বাখ শোনার জন্য যেমন জার্মান ভাষা জানার প্রয়োজন নেই তেমনই লালন গীতির মাহাত্ম্যকে বোঝার জন্য বাংলা না জানলেও চলে। লালন গীতিকে অনুভব করার জন্য কোনো ভাষাই পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।"        

২০১৪ সালে ভারতে প্রথম তিনি পা রাখেন। পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে এসে রাজু দাস বাউলের সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক অ্যালবামের কাজ শুরু করেন। যে অ্যালবামে স্থান পায় 'ধন্য ধন্য বলি তারে', 'তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো', 'হরি দিন তো গেল' ও 'বন্দেমাতরমে'র মতো যুগান্তকারী গানগুলো। এই অ্যালবামের নামকরণ করা হয়েছিল 'ত্রিকালঃ স্বরকান্তি'। অতীত-ভবিষ্যত ও বর্তমানের জীবনদর্শন উঠে আসে অ্যালবামটিতে। বাংলা বাউল ও লোকগীতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিজেকে জুড়ে নিয়েছেন বাঙালিয়ানার সাথে। তিনি মনে করেন "সঙ্গীতের কোনো ধর্ম নেই, কোনো ভেদাভেদ নেই৷"        
         
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আব্দুল করিম, লালন ফকির প্রায় সবারই গান নিয়ে তিনি অ্যালবাম তৈরি করেছেন। তাঁর অ্যালবামের গান চল্লিশটি দেশের বেতারের টপ চার্টে বেজেছে। তিনি বাংলার বাউল গানকে মুড়ে দিয়েছেন পাশ্চাত্যের ছোঁয়াতে। তাঁর স্বপ্ন বাংলার মূলত যে গানগুলোর মাটির সাথে যোগাযোগ সেই গানগুলোকে গোটা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। একজন স্কটিশ হিসেবে বাংলা গান নিয়ে তিনি যেভাবে কাজ করছেন যা এককথায় গর্বের বিষয়। 


তথ্যসূত্র- বেঙ্গলি ডট বিডি নিউজ ২৪, সমকাল, প্রথম আলো, বঙ্গদর্শন

No comments