আফগানিস্তানে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা হয় এক বাঙালির নেতৃত্বে
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু দেশের স্বাধীনতার জন্য বৈদেশিক সাহায্যের জন্য বিদেশে যাত্রা করেছিলেন, একথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু আপনি কী জানেন এরকম আরো অনেক বাঙালিই স্বাধীনতা সংগ্রামে বৈদেশিক সাহায্যের জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। অথচ আমরা তাদের ভুলে গেছি। এনাদের মধ্যে রাসবিহারী বসু, বাঘাযতীন ও শিবনাথ বন্দোপাধ্যায় অন্যতম৷ আজ আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামী শিবনাথ বন্দোপাধ্যায়ের কথা লিখতে চলেছি। যার সংগ্রাম নেতাজীর মতোই ছিল রোমহর্ষক। বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার চেষ্টায় তিনি ১৯২১ সালে আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে সূদুর রাশিয়া পাড়ি দেন৷ রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে তিনি এমন একটি দিনে পৌঁছান যেদিন লেনিন মারা যান৷ তিনি মস্কোতে পৌঁছানোর পর লেনিনের মরদেহ নিয়ে যে শোক মিছিলের আয়োজন করা হয় তাতে পা মেলান৷
রাশিয়া গমনের পূর্বে তিনি আফগানিস্তানের রাজা আমানউল্লাহের সাহায্যে রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের সাথে পরিচিত হন। তিনি কাবুলে অস্থায়ী ভাবে ব্রিটিশ বিরোধী ভারত সরকার গঠন করেন৷ তিনিই ছিলেন এই সরকার গঠনের মূল স্থপতি। খুব সম্ভবত এটিই ভারতের প্রথম স্বাধীন সরকার হিসেবে স্থান পেয়েছে। রাশিয়া পৌঁছে অল্পদিনের মধ্যেই মস্কোর ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে মার্ক্সীয় দর্শন ও রুশ ভাষা রপ্ত করে ফেলেন। তারপর তিনি মস্কোর বলশেভিক পার্টির সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসেন। বৈধ পাসপোর্টে ভারতে যাওয়ার জন্য তাকে বিলেতে রাখা হয়৷ তিনি ১৯২২ সালে বিলেতে লেবার পার্টির নেতা অ্যাটলির সহায়তায় দেশে ফিরে আসেন৷ দেশে প্রত্যাবর্তনের পর মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়৷
রাশিয়াতে থাকার সময়ই তিনি আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থার সংস্পর্শে আসেন৷ রাশিয়া ছেড়ে বাংলাতে ফিরে আসার পর তিনি বাংলার পাটকল শ্রমিকদের জন্য গড়ে তোলেন ভাটপাড়া-নৈহাটি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি। ১৯২৯ সালে লিলুয়াতে তিনি রেলওয়ে ধর্মঘট পরিচালনা করেন৷ ১৯৩৩ সালে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের কানপুর সম্মেলনে তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন৷ বছর চারেক পর হয়ে ওঠেন ইউনিয়নের সভাপতি। ১৯৩৭ সালে চটকলের সকল শ্রমিকদের নিয়ে এক সফল ঐতিহাসিক ধর্মঘটের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি৷ যার প্রভাবে দেশজোড়া খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর৷ আন্দোলনের প্রধান প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন হাওড়ার নিত্যধন মুখার্জী রোডে৷ যার পূর্বনাম ছিল ৪ তেলকল ঘাট রোড। তিনি ছিলেন রেল শ্রমিক সংগঠন ও বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক আইন পরিষদের একজন সদস্য৷ কলকাতার ধাঙড় আন্দোলনেও তিনি নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বিভিন্ন সময় মিলিয়ে তিনি সারাজীবনে প্রায় দশবছর কারারুদ্ধ হয়েছেন৷ ১৯৫৪ সালে চীন সরকারের আমন্ত্রণে চীন ভ্রমণ করেন৷ এখান থেকে ফিরে 'স্মৃতি-বিস্মৃতি নামক একটি বই রচনা করেন। যা তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে স্থান পায়। ১৯৭৫ সালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে তিনি সরে আসেন। তারপর তিনি হয়ে উঠলেন একজন দানবীর৷ বিভিন্ন সামাজিক ও ত্রাণমূলক উদ্যোগ নিতে থাকেন তিনি৷ জনসেবামূলক কাজের মধ্যেই উৎসর্গ করে দেন জীবনের শেষ দিনগুলো।
১৮৯৭ সালের ১১ ই জুলাই বাংলার মাটিতে জন্ম নেন শিবনাথ বন্দোপাধ্যায়। তাঁর জন্মস্থান হলো অধুনা বাংলাদেশের খুলনা। যদিও তাঁর শৈশবকাল কাটে হুগলি জেলাতে। হুগলির নামকরা কলেজ মহসিন কলেজে তিনি বি.এস.সি উত্তীর্ণ হন৷ তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এসসি পড়া শুরু করেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায় প্রবাসিনী দেবীর সঙ্গে তিনি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯২০ সালে গান্ধীজির অনুপ্রেরণায় তিনি অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন ৷
তথ্যসূত্র- সংসদ বাঙালি চরিতাবিধান প্রথম খণ্ড, রাধিকারঞ্জন ব্লগ।
Post a Comment