বাংলার সার্কাসের জনক প্রিয়নাথ বসু যিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস'
দড়ির ওপর দিয়ে কোনো এক তোতাপাখি সাইকেল চালাচ্ছে। কোনো এক মরণ গম্বুজের ভেতরে বাইক নিয়ে খেলা দেখাচ্ছে তিনজন মানুষ। হাতির দল খেলছে ফুটবল। একটা গোল আগুনের চাকতির ভেতর ঘোড়া নিয়ে গলে যাচ্ছে কোনো এক মানুষ। উঁচু জায়গাতে দড়ি ধরে ঝুলে খেলা দেখাচ্ছে কোনো এক মানুষ। এসব দৃশ্য একমাত্র ধরা পড়ে সার্কাসে। একটা সময় ছিল যখন সার্কাসের দারুণ রমরমা ছিল। আফ্রিকান সার্কাস, রাশিয়ান সার্কাস, অজন্তা সার্কাস বিভিন্ন নামের নামীদামী সার্কাস দেখতে ভিড় করতো মানুষ। তিন থেকে চার ঘন্টা এক ভরপুর বিনোদন উপভোগ করার বিশেষ মাধ্যম হলো সার্কাস৷ বর্তমানে সার্কাসের পরিসর ক্ষুদ্র হচ্ছে। এখন আর সার্কাস খুব বেশি দেখা যায় না কোথাও। সার্কাস যেন তার গতি হারিয়ে ফেলেছে।
বেশিরভাগ জায়গাতে বিদেশি কোম্পানির সার্কাসই বেশি চলতো৷ এর ভিড়ে দেশীয় কোম্পানিও যে জায়গা পেত না একথাও ভুল। সময়টা উনিশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের শুরু। কলকাতার বুকে যে-কোনো সার্কাস দলকে টক্কর দিতে তৈরি হয় 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস'। প্রফেসর প্রিয়নাথ বসু হলেন এই সার্কাস দলের প্রতিষ্ঠাতা। মান্ধাতার আমলে সার্কাস বা শরীরচর্চার কোচদের প্রফেসর বলা হতো। বাঙালির প্রথম সার্কাস অভিযানে তিনি গগনচুম্বী সফলতা অর্জন করেন। বাঙালি মানেই নাকি অলস, পরিশ্রমবিমুখ, ভীতু ও দুর্বল এই বদনাম বহুদিনের। যে বদনামকে অনেকাংশে ভেঙ্গে ফেলেন তিনি৷
'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস' প্রতিষ্ঠার জন্য প্রিয়নাথ বসুকে বাংলার সার্কাসের জনক বলা হয়৷ তবে 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস' বাংলার প্রথম সার্কাস দল ছিল না। বাংলার প্রথম সার্কাস দল প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠাতা নবগোপাল মিত্র৷ তাঁর প্রতিষ্ঠিত সার্কাস দল ছিল 'ন্যাশানাল সার্কাস'৷ কয়েকজন বিদেশিদের সঙ্গে নিয়ে তিনি খেলা দেখাতেন। অল্পদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় এই সার্কাসের দলটি। এরপর আসে 'গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস'। যে দলটি ধোপেও টিকলো না৷ তারপর প্রফেসর প্রিয়নাথ বসু ন্যাশানাল সার্কাস ও গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাসের জন্তু-জানোয়ার ও সাজ-সরঞ্জাম কিনে তৈরি করলেন 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস'। যে সার্কাস সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল অভিনব উপায়ে। সার্কাসে ইতিহাস সৃষ্টিকারী নাম 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস'। এই সার্কাসের প্রথম প্রদর্শনী হয় বাংলার বাইরে এবং পরবর্তী কালে কলকাতার গড়ের মাঠে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপ সর্বত্র তাঁর ডাক পড়তো সার্কাস দেখানোর জন্য৷
প্রফেসর প্রিয়নাথ বসু ছিলেন প্রথম বাঙালি যিনি পিরামিড অ্যাক্ট, জাগলিং অ্যাক্ট, হরাইজন্টাল বার, প্যারালাল বার এবং অশ্বারোহীতে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন৷ 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস' এ বাঙালি ক্রীড়াবিদ, পরিচালক, পশু-শিক্ষক, অশ্বারোহী ও বাঙালি মেয়েরাও ঘোড়ায় চড়া, বাঘের খেলা ও ট্র্যাপিজের খেলা দেখাতেন৷ এই দলের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সুশীলা সুন্দরীর বাঘের সাথে খেলা৷ তিনি হলেন প্রথম বাঙালি নারী যিনি সার্কাসে বাঘের সাথে প্রথম খেলা দেখান৷ বাঘের খাঁচাতে ঢুকে রীতিমতো বাঘের সাথে কুস্তি শুরু করে দিতেন তিনি৷ বাঘের গর্জন থামানোর জন্য বাঘের মুখে তিনি মাথা পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিতেন। তার বোন কুমুদিনীও বাঘের খেলা দেখাতেন৷
সুশীলা সুন্দরী বা কুমুদিনীই নয়, আরো অনেক উদাহরণ ছিল 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস' এ। যাদের হাত ধরে দেশীয় সার্কাসে নবজাগরণ ঘটেছিল৷ বাঙালি পুরুষ বাদলচাঁদ বাঘের সাথে খেলা দেখাতেন৷ মৃন্ময়ী দেবী হাতির পিঠে বসে বাঘের সাথে খেলা করতেন৷ চোখে রুমাল বেঁধে ঘোড়ার পিঠে অবলীলায় আগুনের গোলার ভেতরে লাফ মারতেন মন্মথনাথ দে। বুকে পেতে রাখা তক্তার ওপর হেঁটে যাওয়া হাতির ভার সহ্য করার ক্ষমতা রাখতেন ভবেন্দ্রমোহন সাহা। পান্নালাল বর্ধন তাক লাগানো জিমন্যাস্টিক দেখাতেন৷ দলের বিশ্ববিখ্যাত জাদুকর গণপতি চক্রবর্তী 'ইলিউশন বক্স', 'ইলিউশন ট্রি' ও 'তাস'এর বিস্ময়কর জাদু দেখাতেন। 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস' যেন আশ্চর্যে ভরা ছিল৷ এরকম সার্কাস দল আজ আর নেই বললেই চলে।
বাংলার ইতিহাসে 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস' এক গর্ব। ১৮৮৭ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত খেলা দেখিয়েছিল এই সার্কাস। ১৯২০ সালে সিঙ্গাপুরে তিনি দল নিয়ে সার্কাস দেখাতে যান। সেখানে হঠাৎ করেই জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে পঞ্চান্ন বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েছিল 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস৷ বাঙালির উদ্যমশীলতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো এই সার্কাস। কাজেই কোনো বাঙালিকে ভুলে গেলে চলবে না বাঙালি কোনো অংশে কম নেই৷ বাঙালি পারেনা পৃথিবীতে এমন কাজ নেই। 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস' থেকে সকল বাঙালির শিক্ষা নেওয়া উচিৎ। 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস' বাঙালির মেরুদণ্ড সোজা করার চেষ্টা করেছিল। 'বাঙালির সার্কাস' নামে একটি বাংলা বইতে 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের বিস্তারিত বিবরণ আছে৷ যে বই পড়লে এই সার্কাস সম্বন্ধে আরো অনেক জানা-অজানা কথা জানা যাবে।
তথ্যসূত্র- প্রিয়লেখা ব্লগ, সংসদ বাঙালি চরিতাবিধান প্রথম খণ্ড
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment