Header Ads

স্মৃতির অলিন্দে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. অমলেন্দু বন্দোপাধ্যায়


ঠিক মাসখানেক আগের কথা। ২৩শে জুন রথযাত্রা দিন দুপুরে হঠাৎ খবরটা পাই যে, স্বনামধন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তার আগের দিন অর্থাৎ ২২শে জুন রাত সাড়ে আটটায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বলা যায় এই মর্ত্যলোক ছেড়ে তিনি অন্য এক জ্যোতির্লোকে পাড়ি জমিয়েছেন। এই প্রয়াণের খবরটা শুনে স্বভাবতই বেশ মুষড়ে পড়েছিলাম। একরাশ স্মৃতি চোখের সামনে ভিড় করে আসছিল। এইতো ক’দিন আগে অমলেন্দুবাবুর আমাকে উপহার দেওয়া "জ্যোতিষ কি আদৌ বিজ্ঞান?" বইটি পড়ে শেষ করলাম। সত্যি, কি অসাধারণ লেখনীর দ্বারা জ্যোতিষশাস্ত্রের ভ্রান্ত ধারণাগুলিকে তিনি তুলে ধরেছিলেন বইটিতে। তার চেয়ে বড়ো কথা এই এপ্রিল মাসেই শুভ নববর্ষ উপলক্ষে শ্রদ্ধেয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে শুভেচ্ছা ও প্রণাম জানানোর জন্য যখন ফোন করেছিলাম তখন তাঁর সাথে কত কথাই না হল।


লকডাউনের ফলে দূষণ কমে যাওয়াতে আকাশ বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। তাঁর সাথে কথা বলছিলাম লকডাউনের পরিষ্কার আকাশে চাঁদ ও নক্ষত্র নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, "চাঁদটা কি পরিষ্কার দেখাচ্ছে।" আসলে, শহরের এত দূষণের ফলে বেশ অনেক বছর পর আকাশ এত পরিষ্কার ও সেই পরিষ্কার আকাশে এত নক্ষত্র এবং সেইসব  নক্ষত্রদের উদয় হওয়ার লক্ষ্য করেছিলাম। সেই বিষয়েও তাঁর সাথে কথা হচ্ছিল। তাঁর চলে যাওয়ার আগের দিন ছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। সূর্যগ্রহণ নিয়ে মানুষের এত অপবিজ্ঞান ও কুসংস্কার দেখে সেদিনও তাঁর কথা বারবার মনে পড়ছিল। এ বছরের সরস্বতী পুজোর দিনের কথাও মনে পড়ছিল সেদিন রাতে বইমেলা থেকে যখন ফিরছি তখন তাঁর ফোন এসেছিল। আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ থেকে প্রকাশিত ‛জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল যা তাঁর পঠিত আমার অন্যান্য বিজ্ঞান প্রবন্ধের মতোই খুব ভালো লেগেছিল। তাঁর মতো একজন স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিকের থেকে বাহবা ও ভূয়সী প্রশংসা সত্যি বলতে কি সরস্বতী পূজোর দিনটি সার্থক করে তুলেছিল। এই কথাটি তাঁকেও আমি জানিয়েছিলাম। সরস্বতী পুজোর দিন লাভ করেছিলাম সরস্বতীর বরপুত্র বা সারস্বত সাধকের আশীর্বাণী। এর আগেও আমার জনপ্রিয় বিজ্ঞানের একটি বই প্রকাশের পর বইটি তাঁকে দিয়েছিলাম। তিনি খুব খুশি মনে তা গ্রহণ করে পড়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা ও মূল্যবাণ মতামত লাভ করেছিলাম। বেশ ভালো লাগে, মনে একটা তৃপ্তি লাভ করি যখন ভাবি যে এরকম একজন স্বনামধন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী থেকে মূল্যবাণ মতামত ও লেখার প্রশংসালাভ করেছি। আবার এর সাথে এক বিস্ময়ের উদ্রেক হত যে তিনি কিভাবে এই বয়সেও প্রতিটি লেখা খুঁটিয়ে পড়েন আর তাঁর অসামান্য বা অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার দ্বারা প্রকাশিত অতি মূল্যবাণ মতামত কোনদিনও ভোলার নয়। তাঁর অদম্য কৌতুহল ও জ্ঞানলাভের অকৃত্রিম স্পৃহা সবাইকেই নিঃসন্দেহে বিস্মিত করে তুলতো। আসলে, সত্যি বলতে কি, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চায় বরাবরই তাঁর কাছ থেকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলাম যা আমাকে এই বিজ্ঞানচর্চার পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আমার লেখা সম্পর্কে তাঁর "চমৎকার লেখা হয়েছে তোমার" কথাটি আমাকে আরও বল জুগিয়েছে। খুব বেশি বছর হয়নি তাঁর সাথে আলাপ হয়েছিল। তবুও এর মধ্যে তাঁর অকৃত্রিম স্নেহ, আতিথেয়তা, আশীর্বাদ, আদর, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা কোনদিনও ভোলার নয়। এইসব স্মৃতিতে থেকে যাবে চিরকাল। বিস্তারিত স্মৃতিচারণা পরবর্তী কোনো এক প্রতিবেদন করব। এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করব অমলেন্দুবাবুর জীবন ও কর্ম নিয়ে।

অধ্যাপক অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯৩০ সালে অবিভক্ত বাংলার হাওড়া জেলার মুগকল্যাণ গ্রামে। তাঁর স্কুল জীবন কাটে এই গ্রামে। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করতে হয়েছিল তাঁকে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা তিনি করেছিলেন বারাণসীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫২ সালে ফলিত গণিত নিয়ে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এসসি. ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। এম.এসসি.-তে বিশেষ পাঠ্যবিষয় ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান। তখন থেকেই হয়তো তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে এক পরম সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। আর এই বিষয়ে তিনি আরও অনুপ্রেরণা পান হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের খ্যাতনামা অধ্যাপক বিষ্ণু বাসুদেব নারলিকার-এর কাছে। এই বিষ্ণু বাসুদেব নারলিকার হলেন বর্তমান যুগের বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার-এর পিতা। বাসুদেব নারলিকারের কাছে অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ার পরম সৌভাগ্যলাভ করেছিলেন। আর এর পাশাপাশি পেয়েছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা করার এক অনুপ্রেরণা। এম.এসসি. পাশ করার পর পরবর্তী চার বছর বারাণসীর একটি কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেন। অর্থাৎ তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল গণিতের অধ্যাপনার মাধ্যমে। স্বনামধন্য জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী ড.মেঘনাদ সাহার সাথে তাঁর পরিচয় ছিল। ড.সাহা অত্যন্ত স্নেহ করতেন তাঁকে এবং তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিপুল আগ্রহের কথাও জানতেন।

১৯৫৬ সালে ড.মেঘনাদ সাহা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত 'নটিক্যাল অ্যালম্যানাক ইউনিট'-এ অমলেন্দুবাবু যোগদান করেছিলেন। এই নটিক্যাল অ্যালম্যানাক ইউনিট ছিল অবস্থানিক জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণার কেন্দ্র। প্রায় ছ’বছর ওই  উক্ত কেন্দ্রে জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণায় তিনি নিযুক্ত ছিলেন। এরপর, ১৯৬২ সালে তিনি বিমান চালনা সংক্রান্ত আবহাওয়া বিজ্ঞানের গবেষণায় নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর সাথে ঘরোয়া এক আলোচনায় উঠে এসেছিল যে এই কেন্দ্রে থাকাকালীন ডিরেক্টরের সাথে সমস্ত কর্মীর মনোমালিন্য হয়েছিল এবং তা তিনি কিভাবে এক বিধায়কের সাহায্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হস্তক্ষেপে তার সমাধান হয়। এখানেও ছ’বছর কাটিয়ে ১৯৬৮ সালে আবার আগের নটিক্যাল অ্যালম্যানাক ইউনিটের পুরো দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দীর্ঘ বারো বছর তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে যা তাঁর ভাষায় "মুখের রক্ত তুলে খাঁটাখাটনি করার পর", এই ইউনিটটি কলকাতায় ভারত সরকারের একটি আন্তর্জাতিক অবস্থানিক জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার সংস্থায় রুপান্তরিত হয়। যার ফলে, ১৯৮০ সালে ওই সংস্থাটি সম্প্রসারিত হয়ে 'পজিসন্যাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার' হিসেবে নতুন নামকরণ হয় আর অমলেন্দুবাবু হন এই সংস্থার  প্রথম ডিরেক্টর। ১লা ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮ সালে ৫৮ বছর বয়সে তিনি ওই সংস্থা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর, ১৯৮৯ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি কলকাতার সুপ্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র এম.পি. বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামের জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক গবেষণা বিভাগে ‛সিনিয়র সায়েন্টিস্ট’ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। 

প্যারিসে অবস্থিত 'ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন' হল বিশ্বের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার সর্বোচ্চ সংস্থা। সেই সংস্থার তিনি ছিলেন নির্বাচিত সদস্য, বলা ভালো সেই সংস্থার বা ইউনিয়নের এফিমারাইডাস্ কমিশনে একমাত্র ভারতীয় সদস্য। এছাড়াও, তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডে অবস্থিত অত্যন্ত খ্যাতিসম্পন্ন 'রয়্যাল অ্যাস্ট্রনমিক্যাল সোসাইটি'-র নির্বাচিত ফেলো। ইংল্যান্ডের আরেক খ্যাতিসম্পন্ন ও অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা ‛ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর তিনি ছিলেন সম্মানিত একজন নির্বাচিত সদস্য। অমলেন্দুবাবু 'পশ্চিমবঙ্গ অ্যাকাদেমি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি'র ফেলো ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা বিষয়ক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, চীন ও কোরিয়ায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। তাঁর প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা পঞ্চাশেরও উপর। গত ১৬ই জুলাই ছিল বাংলার কিংবদন্তি জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের জন্মদিবস। সেদিনও খুব মনে পড়ছিল বেশ কয়েক বছর আগে পড়া রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের উপর অমলেন্দুবাবুর ও রণতোষ চক্রবর্তীর "Radha Gobinda Chandra- A Pioneer In Astronomical Observations In India" নামক গবেষণাপত্রটি। 

অমলেন্দু বাবু বাংলায় তো বটেই এমনকি ইংরেজিতেও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে গেছেন। এই দুই ভাষায় তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা আড়াই হাজারেরও বেশি। আর এইসব প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম শ্রেণির বাংলা ও ইংরেজি পত্র-পত্রিকায়। ইংরেজিতে তিনি তিনটে ও বাংলায় পাঁচটা বই রচনা করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে যখন ৭৬ বছর পর আবার হ্যালির ধূমকেতু পৃথিবীর কাছাকাছি চলে এসেছিল তখন 'শতভিষা' পত্রিকার সম্পাদক বিশিষ্ট কবি শ্রী মৃণাল দত্তের উৎসাহে এবং বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক এবং তৎকালীন আনন্দমেলা পত্রিকার সম্পাদক শ্রী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একান্ত আগ্রহে অমলেন্দু লিখেছিলেন ধূমকেতু (বিশেষ করে হ্যালির ধূমকেতু) নিয়ে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'ধূমকেতুর রহস্য ও হ্যালি'। বেশ কয়েক বছর আগে যখন ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশন (ইউজিসি) 'জ্যোতিষবিদ্যা'-কে পাঠক্রমে  আনতে চাইছিল তখন তিনি এর প্রতিবাদস্বরূপ একটি বই লেখেন যার নাম 'জ্যোতিষ কি আদৌ বিজ্ঞান?' বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর বইটির বিপুল জনপ্রিয়তার জন্যে একে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। ইংরেজিতে অনূদিত বইটির নাম হয় 'Is Astrology A Science?' এই ইংরেজি বইটিও বাংলার মতোই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। 'Is Astrology A Science?' বইটি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও স্বনামধন্য বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালাম এবং বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার-এর বিপুল প্রশংসা লাভ করে। অগণিত পাঠক এই বইটি পড়ে জ্যোতিষবিদ্যার ভ্রান্ত ধারণার সাথে পরিচিতি লাভ করেছিল। এভাবেই, প্রবন্ধ ও বই লিখে জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা তুলে ধরে জ্যোতিষশাস্ত্রের ভান্ত দিকগুলি মেলে ধরতেন। 

রেডিও এবং দূরদর্শনেও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক অসংখ্য জনপ্রিয় অনুষ্ঠান করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথাগুলোকে মানুষের সামনে তুলে ধরতেন। তাঁর একটি প্রাণের নেশা ছিল আর তা হল জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত নানা বিষয়ের বিভিন্ন রঙীন স্লাইড দেখিয়ে জনপ্রিয় লেকচার দেওয়া। এভাবেই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানকে বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি গ্রামে-গঞ্জেও জনসাধারণের মধ্যে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচারের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তুলতেন। তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞানের এরকম লেকচারের সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি। এই স্লাইড দেখিয়ে লেকচারের কথা তাঁর এতটাই প্রাণের শখ ছিল যে এই শেষ বয়সে এসে আমাকে বলেছিলেন এই স্লাইডের কথা আর এও বলেছিলেন যে, "যদি কোথাও লেকচার দিতে হয় তাহলে বলো।" এতটাই তাঁর আগ্রহ ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানকে মানুষের দরবারে পৌঁছে দেবার।  

জ্যোতিষশাস্ত্র যে ভ্রান্ত তা বারবার প্রচার করে গিয়েছেন। জ্যোতিষমহল থেকেও যে বাধা আসত না তা নয়। ১৯৯১ সালের ১৭ই নভেম্বর, দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার ক্রোরপত্রে প্রচ্ছদ হিসেবে লিখেছিলেন 'Do Planets Rule Our lives?' অর্থাৎ 'গ্রহরা কি আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে?'– একেবারে জ্যোতিষশাস্ত্রের বদ্ধমূল ধারণায় আঘাত করেছিলেন। নিবন্ধটি নিঃসন্দেহে শিক্ষিত সমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলে। নিবন্ধটির প্রশংসা, নিন্দা, আবেগ, আক্রোশ, যুক্তি-অপযুক্তি দেখিয়ে পত্রিকার দপ্তরে "Letters to the Editor" কলামে প্রচুর চিঠি আসতে শুরু করে। সম্পাদক তো অবাক কেননা এত সংখ্যক চিঠি আগে কখনো কোনো নিবন্ধের জন্যে আসেনি। বোঝাই যাচ্ছে, ওই নিবন্ধটির জনপ্রিয়তা কি তুঙ্গে ছিল। কিন্তু যে শাস্ত্র বলে "গ্রহরা আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে" তার ধ্বজাধারীরা কি অমলেন্দুবাবুর কথা সহজে মেনে নিতে পারবেন? তাদের মৌচাকে যে মোক্ষম ঢিল ছোঁড়া হয়েছে। আর তার ফলস্বরূপ, যেদিন এই লেখাটি প্রকাশিত হয় সেদিন সকাল থেকেই অমলেন্দুবাবুর বাড়িতে ফোন আসতে শুরু করে এবং সেইসব ফোনে তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এমনকি প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে নানারকম উড়ো চিঠিও আসতে শুরু করে। অবশেষে, কলকাতা পুলিশের বড়ো কর্তার শরণাপন্ন হওয়ার পর এসব উপদ্রব বন্ধ হয়। এও জানা যায় যে, ভিমরুলের চাকে ঢিল পড়াতে এক শ্রেণির রত্ন-ব্যবসায়ীরা তাদের অসাধু ব্যবসার দারুণ ক্ষতি হবে ভেবে ভয় দেখিয়েছিল। কিন্তু, অমলেন্দুবাবুর মতো সৎ ও নির্ভীক মানুষকে এবং তাঁর কাজকে তারা দমাতে পারেনি।

সারা ভারতে ইংরেজি ও বাংলায় কেবলমাত্র জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লেখার জন্যে ১৯৯৫ সালে ভারত সরকার তাঁকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রদান করেন। পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যে ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন 'গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার' দেন।  গোটা দেশজুড়ে ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানের তথ্যগুলোকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এবং জ্যোতিষ সংক্রান্ত কুসংস্কারগুলো সাধারণ মানুষের মন থেকে দূর করার অদম্য প্রচেষ্টায় জন্য অমলেন্দুবাবুকে ২০০৩ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.এসসি. প্রদান করা হয়। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে, তাঁর ঘরের দেওয়ালে দেখেছিলাম বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.এসসি. ডিগ্রি বাঁধানো ছবি, 'পজিসন্যাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার'-এর তাঁকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের গ্রুপ ফটো, এক জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানীর সাথে তাঁর ছবি আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছবি হল একটি পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের যাতে 'রিং অব ফায়ার' দেখা যাচ্ছে। অমলেন্দুবাবু জানিয়েছিলেন যে আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরে তুললেও সূর্যগ্রহণের সময় সৃষ্ট 'রিং অব ফায়ার'-এর এমন দুর্লভ ছবি পাওয়া যেত না। অমলেন্দুবাবুর বইয়ের ঘরে দেখেছিলাম জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত নানা বই। কত আগ্রহ ও ভালোবাসা ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানে তা তাঁর সাথে আলোচনা করলেই বোঝা যেত। যাই হোক, আবার ফেরা যাক পুরস্কারের কথায়। প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা জনসাধারণের মাঝে প্রচার করার জন্য ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন সম্মাননা 'জগত্তারিণী' স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে, ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন ‛জি.পি. চ্যাটার্জি স্মৃতি পুরস্কার'-এ পুরস্কৃত করে। এই পুরস্কার তাঁকে দেওয়া হয় তাঁর এই দেশে অবস্থানিক জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ অবদান রাখার জন্যে।

অমলেন্দুবাবুর জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর নানা স্লাইড দেখানোর শখের কথা তো আগেই বললাম। তিনি দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করতে ভালোবাসতেন। সঙ্গীতেও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল, তিনি মার্গ সঙ্গীত শুনতে খুব ভালোবাসতেন। এছাড়া তিনি রবীন্দ্র-সঙ্গীতের রেকর্ড সংগ্রহ করতেও পছন্দ করতেন। ঘরোয়া আড্ডা দিতে উৎসাহী ছিলেন। জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে লোককে বোঝাতে ভালোবাসতেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা তথা বিজ্ঞানচর্চায় কারুর উৎসাহ দেখলে খুব খুশি হতেন এবং সেই উৎসাহ আরও বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করতেন। শেষ বয়সেও উৎসাহ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় এমনকি গ্রামে-গঞ্জেও জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেকচার দিতে যেতেন। বৃদ্ধ বয়সে এসেও তাঁর মতো এরকম আগ্রহ অনেকের মধ্যেই দেখা যায় না। বর্তমান সময়ে যখন আকাশে নিওওয়াইজ ধূমকেতু দেখা যাচ্ছে তখন এর আগে উল্লেখ করা অমলেন্দুবাবুর ধূমকেতু নিয়ে সেই বিখ্যাত 'ধূমকেতুর রহস্য ও হ্যালি' নামক  বইটির কথা সমস্ত স্তরের পাঠকের মনকে যেন টানছে। 

স্বনামধন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন, উপদেশ, জ্যোতির্বিজ্ঞানে গবেষণার কাজ, জ্যোতিষ শাস্ত্রের ও জ্যোতিষীর ভণ্ডামি প্রকাশ্যে আনা তথা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এক বিজ্ঞান আন্দোলন চালানো এবং বাংলা জ্যোতির্বিজ্ঞান সাহিত্যে বিপুল অবদান আমাদের জীবনের এক অনুপ্রেরণা বা পাথেয়। তিনি থাকবেন ভারতের তথা বিশ্বের জ্যোতির্বিজ্ঞানের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে। নিঃসন্দেহে তাঁর চলে যাওয়া বিজ্ঞান জগতের এক বড়ো ক্ষতি। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা জানিয়ে এই প্রতিবেদনটি তাঁর প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে নিবেদন করা হল। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। তাঁর প্রতি আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা চিরকাল থাকবে। 


No comments